। ড. অখিল পোদ্দার ।
বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেছিলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায
মঞ্চজুড়ে হালকা আলো; সাদামাটা কক্ষে পায়চারি করছেন শেখ মুজিব। দীপ্তিময় প্রক্ষেপণ তাঁর অবয়ব ছাড়িয়েছে। তাতে অনাড়ম্বর পানজাবির গোটানো হাতা সবিশেষ সাদাসিধে; পায়ের চটিজোড়া স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
মুজিব হাঁটছেন মেঝের এপ্রান্ত হতে সেপ্রান্তে। অতপর দাঁড়ালেন মাঝ বরাবর। চুরুটের র্ধোঁয়ায় হালকা আচ্ছন্ন। সব নৈর্বক্তিকতা ছাপিয়ে হাজারো দর্শকের জোড়াচোখ আরেকবার দেখলো এদেশের মানচিত্র কিংবা তাঁর বিশাল বুক। অকস্মাৎ ঘরে ঢুকলেন তাজউদ্দিন।
মুজিব আড়মোড় ভেঙে বলে উঠলেন- ‘তাজউদ্দিন, এ্যাতো ফরমালিটি করো ক্যান? তুমি হলে গিয়ে বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। আমার ঘরে যহন কেউ থাকবে না, হানিপকে জিজ্ঞাসা করবা- ভিতোরে ঢুকে পড়বা। আর এটা তো গণভবন না, এটা তো বত্রিশ নম্বর বাড়ি, নাকি!’
-আপনি এখন দেশের প্রেসিডেন্ট। আমি অর্ডিনারি সিটিজেন। পার্থক্যটুকু আমাদের থাকতেই হবে।
-তাজউদ্দিন, আমি তোমার কাছে মুজিব ভাই হয়েই থাকতে চাই।
স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন শেখ মুজিব। দরাজ কণ্ঠের অনুরণন ছড়িয়ে পড়লো অডিটরিয়ামের দেয়ালে দেয়ালে।
ততোক্ষণে অজস্র করতালি। জয় বাংলা ধ্বনিতে আরেকবার কম্পিত হলো লন্ডনের লোগান হল। অতপর দু’ঘন্টা ধরে চলা নাটকের বাঁকে বাঁকে তৈরী হলো ক্লাইমেক্স। অন্ত:চাপের নিস্তবন্ধতা ভেঙে বাঙালি আবারও জেগে উঠলো। কেউ কেউ বললেন, জয় বঙ্গবন্ধু।
বলছিলাম ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন আবহ। সময়টা ২০০৪ সালের মার্চ। শীতের সুবায়ু কিছুটা থাকলেও মানসিক প্রদাহ ছিল মনে-মননে। বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসন তখন চলমান। তমসাঘন সময়ে নাটক দূরে থাক বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণেও ঝুঁকি ছিল। জীবন মুঠোয় রেখে ‘প্রোটাগনিস্ট ক্যারেকটার’ করেছিলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি একাধারে নাট্যজন, লেখক ও সাংবাদিক। ক্রান্তিকালে শেখ মুজিবের ভূমিকায় অভিনয় করাটা ছিল তাঁর জীবনের আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ অধ্যায়। ২৩ সেপ্টেম্বর কিংবদন্তি পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন। আজকের দিনে তিনি ছাড়িয়ে গেলেন বয়স ৭২। তাঁর জন্য শতায়ু প্রার্থনা।
শ্যাম বেনেগাল থেকে শুরু করে কেউ কেউ জাতির জনককে মহিমান্বিত করতে সগৌরবে কাজ করছেন। কিন্তু এও সত্য যে, বহুমাত্রিক লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরীর ডাকে ২০০৩-২০০৪ সালে কেউ সাড়া দেননি। লন্ডন-আমেরিকায় গিয়ে মঞ্চ নাটক করবেন, সিরাজ-উ দ্দৌল্লার মতো করুণ মৃত্যুদশা তুলে ধরবেন-এ ছিল এক শূণ্য কল্পনা।
‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ ডকু-ড্রামার নেপথ্যের কাহিনী জানতে চাইলে নাট্যজন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, পলাশীর প্রান্তরে মীরজাফরের দল যা করেছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরেও তার সবিশেষ মিল পেয়েছিলেন বোদ্ধা সাংবাদিক গাফফার চৌধুরী। কাহিনীটিকে মঞ্চনাটকে রূপ দিতে বেশ ক’জন লিজেন্ড অভিনেতার সঙ্গে কথাও বলেন। কিন্তু কেউ রাজি হননি শেখ মুজিবের চরিত্রে অভিনয় করতে। বহু খোঁজাখুঁজির পর পীযূষ ব্যানার্জীকে পেয়েছিলেন। প্রস্তাব দিলে অতপর পীযূষও রাজি হয়ে যান।
অবশ্য এর একটা বিশেষ সুবিধে খুঁজে পেয়েছিলেন নাট্যকার গাফফার চৌধুরী। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ফরিদপুরে। কৈশোরে বেড়ে ওঠা গোপালগঞ্জে। কথাবার্তায় বঙ্গবন্ধুর যে বিশিষ্টতা তার পুরোটাই ছিল পীযূষের মধ্যে। আঞ্চলিকতার মিষ্টি ভাব, ভাষার সারল্যপনা ও অহমবোধ ঠিক রাখতেই ঐ এলাকার একজনকে খুঁজছিলেন গাফফার চৌধুরী।
কথায় কথায় পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ২০০১ সালের পর থেকে দেশব্যাপী যে বর্বরতা চালিয়েছিল জোট সরকার তাতে ভয় পেয়েছিল বহু মানুষ। কিন্তু পরবাসী গাফফার চৌধুরী লন্ডনে থেকে দমে যাননি। ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকটি মঞ্চোপযোগী করতে জাতির জনকের ছোট মেয়ে শেখ রেহানার সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। উপদেশ পেয়েছেন বড় মেয়ে শেখ হাসিনার কাছ থেকেও। কিন্তু দিন-ক্ষণ এগিয়ে আসতেই সব তালগোল পাকিয়ে যায়। যারাই কথা দিয়েছিল তারা আর অভিনয় করতে চাইছিলেন না। সেই অবেলায় হাসান ইমাম, লায়লা হাসান, প্রফেসর রতন সিদ্দিকীসহ আরও ক’জনের সার্বিক সহযোগিতা ছিল উল্লেখ করার মতো। উদীচী ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কেউ কেউ এগিয়ে এসেছিল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। বাংলাদেশ থেকে কোনো নাট্যকর্মী যাতে লন্ডনে যেতে না পারেন বিভিন্ন সংস্থা সেব্যাপারে সজাগ ছিল। প্রচণ্ড মানসিক চাপ উপেক্ষা করে শেষতক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় পাড়ি জমান লন্ডনে। শুরু করলেন রিহার্সাল।
শেখ মুজিবের চরিত্রে অভিনয় করবেন-দিনরাত তাই মুজিবের খুঁটিনাটি সংগ্রহ করতেই ব্যস্ত থাকা। দিনের পর দিন নিউ মার্কেট খুঁজে উদ্ধার করতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মোচ। কেমন সেন্ডেল পড়তেন, চুল আঁচড়াতেন কিভাবে, পানজাবির হাতা কেমন করে গোটাতেন আর কেমন করেই বা চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেন-সবই রপ্ত করতে হয়েছিল পীযূষকে।
পূর্ব লন্ডনের একটি বাড়িতে রিহার্সাল হতো। ইউরোপের আরও ক’টি দেশ থেকে কুশীলবেরা এসেছিল। যাদের কেউ কেউ একেবারে নবীন। অভিনয় সম্পর্কে তেমন ধারণাও ছিল না। চেতনার বশে দু’জন ছুটে এসেছিল নিউ ইয়র্ক থেকে। মানিক ও মাহবুবুলের অবদান এখনো মনে ধরে পীযূষের। অর্থাৎ একদিকে জোট সরকারের চলমান বর্বরতা অপরদিকে সঙ্গোপনে গণনাটকের প্রস্তুতি। শম্ভ মিত্র, উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্যদের আদলে রাস্তার মোড়, গঞ্জের ভিঁড় কিংবা অপেরা হাউজের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিল জাতির জনকের আত্মত্যাগ। ইতিহাস বিকৃতির বিপরীতে ইউরোপবাসীকে জানাতে চেয়েছিল নানামূখি ডামাডোলের কারণে ‘প্রমিথিউস’ মুজিবের নাম কেনো ভুলতে বসেছিল বাঙালি। এমনকি শেখ সাহেবকে যাতে ভুলতে বাধ্য হয় তার জন্য প্রকল্পও নেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রিয়ভাবে।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় সাক্ষাতকার দেন। অকপটে বলে যান ঐ সময়ের ঘনঘটা।
নানান ধরণের ডকুমেন্ট ঘেঁটে আবদুল গাফফার চৌধুরী নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, জিয়াউর রহমানই শেখ মুজিবের খুনি। ইতিহাসের ছাত্র গাফফার চৌধুরী সে সময় বহু ধরণের চোথা ঘেঁটে আবিষ্কার করেছিলেন মুজিব সম্পর্কে অজানা সব তথ্য।
নাটকটি বাংলাদেশে মঞ্চস্থ করা একেবারেই অসম্ভব ছিল। লন্ডন পুলিশের অনুমতি মিললেও বাঙালি প্রতিপক্ষদের ব্যারিকেড ছিল। চেষ্টা হয়েছিল হামলা করে লন্ডভন্ড করার। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে নাটকটির স্ক্রিপ্ট এসেছিল যারপরনাই সঙ্গোপনে। বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের তত্ত্বাবধান না হলে প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্থ হতো-বলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে- পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় নিবিড়ভাবে ব্যাপারটি বিশ্বাস করেন। মানুষের আস্থা ও চেতনা ফেরাতে ২০০৫ সালে ডকু ড্রামাটির ভিডিয়ো ধারণ হয়েছিল। তাও বেশ গোপনে। কলকাতার একটি স্টুডিওতে চলে শ্যুটিং। মঞ্চের যারা কুশীলব ছিল তারা বিভিন্ন দেশ থেকে কলকাতায় জড়ো হয়েছিল। স্বাধীন দেশে চেতনামুক্তির কাজ তারা ছিল বদ্ধপরিকর। চলতেন গেরিলা কায়দায়, ফোনে কথাও বলতো ইঙ্গিতে। এরপরও বাড়ে ঝুঁকি, আসে আঘাত। পুলিশ হেফাজতে চলাচল করতে হয় পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
জীবনের ৭২ টি শীত-বসন্ত পেরুনো নাট্যজন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরেকটি স্মৃতি বিশেষ মনে পড়ে।
২০০৫ সালের কোনো এক সন্ধ্যায় ব্রুকলিনে অভিনীত হয়েছিল ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি।’ হলভর্তি দর্শক সেদিন অনেক। একেকটি ডায়ালগ শেষ হতেই মুহুর্মূহু করতালি আর জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান। মঞ্চে সেদিন আলোর প্রক্ষেপণও ছিল ব্যাকরণ মেনে। সবমিলে শো শেষ হবার পর এক বৃদ্ধা এসেছিলেন গ্রিণ রুমে মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে। হাতটা ধরে করুণভাবে বলেছিলেন, শেখ মুজিবকে দেখিনি। তোমাকে দেখে মনটা ভরে গেলো।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল-অভিনয়জীবনটা সার্থক হলো আজ। একই সময়ে এ্যাস্টোরিয়াতে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’র শো হয়েছিল। সেখানেও হলভর্তি দর্শক ছিল কিন্তু ব্রকলিনের ঘটনা আজও ভুলতে পারেন না। । নিউ ইয়র্কের মঞ্চায়ন এতোটাই গোছানো ছিল যে, অন্য স্টেটের বাঙালিরা একের পর এক আমন্ত্রণ জানাতে থাকে। যেমন করে আগের দিনে যাত্রাদলের বায়না হতো।
অতপর বিভিন্ন দেশ থেকে ডাক আসে। কিন্তু এতোবড় লটবহর নিয়ে দেশে দেশে মঞ্চায়ন করাটা ছিল সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। কর্মজীবীদের একসঙ্গে হওয়াটাও ছিল আরেক চ্যালেঞ্জ। পরে সিদ্ধান্ত হয়-এভাবে মঞ্চায়ন নয়, ভিডিয়োতে রূপ দিয়ে সিডি পাঠাতে হবে দেশে দেশে। শেষতক তাই হলো। ২০০৬ সালে কলকাতায় শেষ হয় দৃশ্যধারণের কাজ। ইউটিউবের কল্যাণে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ ডকু ড্রামা এখন সবাই দেখতে পান।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বঙ্গবন্ধুকে এখন প্রতিদিন দেখে মানুষ। প্রতিক্ষণ তাঁর কণ্ঠ শোনেন। কিন্তু ঐ সময়টিতে হামলা-মামলা উপেক্ষা করে প্রমিথিউস মুজিবকে জনতার অন্তর্গহীনে দাঁড় করানোটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং।
- এখন কমার্শিয়াল ভেঞ্চার থেকে সিনেমা হচ্ছে জাতির জনককে নিয়ে। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশা, এসব কাহিনী সবার মনে দাগ কাটবে। কিন্তু ২০০৪ সালে গাফফার চৌধুরীর প্রয়াসটি যেমন ধ্রপদী তেমনি সন্ধ্যাদ্বীপের মতো জাজ্বল্যমান।
-যে কথা না বললেই নয়-বলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
গাফফার চৌধুরী যখন রিস্কটা নিতে বলেছিলেন তখন থেকেই ঘুমের আগে-পরে কল্পনাতে শুধুই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। জীবদ্দশায় বহুবার সামনে থেকে কিংবদন্তিকে দেখলেও তাঁর জীবনভূমিকায় অভিনয় করা ছিল সর্বোপরি দু:সাহসিক। তাঁর মধ্যে ডুব না দিলে কিংবা অস্তস্থলে লীন না হলে মুজিবের ঢেউ দোলা দিবে না। সুতরাং ¯উদ্বিগ্ন সময়ে বসবাস করে আরেকটি স্রোতকে প্রোজ্জ্বল করে তোলাই ছিল সেদিনের পরম দায়িত্ব।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, বহুজন এখনো শেখ মুজিবকে বুঝতে চায় না। আন্তরিক দীনতা থেকেই তাঁর চেতনাকে আঘাত হানে বারংবার। কখনো শারীরিকভাবে, কখনো সোশ্যাল মিডিয়াতে কিংবা অযথাই হেয় করে মানসিকভাবে প্রতিশোধ নিতে চায় বিপরীত স্রোতের মানুষগুলো।
খুব জোর দিয়ে বলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়-বঙ্গবন্ধুর কন্যারা আছেন বলেই নির্ভয়ে থাকি। ঘুমাই নিশ্চিন্তে;
(লেখক: ড. অখিল পোদ্দার, প্রধান বার্তা সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন। Email: podderakhil@gmail.com)
পাঠকের মন্তব্য