গণমাধ্যম সংযোগ । খন্দকার আলী আর রাজী
জার্নাল+ইজম মিলিয়ে তৈরি হয়েছে জার্নালিজম কথাটা। এই “ইজম” প্রত্যয়যুক্ত যত ইংরেজি শব্দ আছে সেগুলোর বাংলা করার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় “বাদ” প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয়েছে।
যেমন, ক্যাপিটালিজম=পূঁজিবাদ/ধনবাদ, ফ্যাসিজম=ফ্যাসিবাদ, ফেমিনিজম=নারীবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই “ইজম” বা “বাদ” প্রত্যয়টি দিয়ে, যে কাজটির বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে সেই কাজটির একটি আদর্শ আছে এই ঘোষণা যুক্ত করা হয়৷
কিন্তু কি এক অজানা কারণে “জার্নালিজম” শব্দটার বাংলা করার সময় “ইজম” প্রত্যয়টি একেবারে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। প্রকৃতপ্রস্তাবে জার্নাল+ইজম-এর বাংলা হতে হতো সাংবাদিকতা+বাদ= সাংবাদিকতাবাদ।
কিন্তু তা হয়নি। আমাদের পূর্বপুরুষরা সম্ভবত অনুমান করতে পেরেছিলেন এক কালে বাংলাদেশের জার্নালিজমে কোনো আদর্শ/বাদ থাকবে না, তাই শুরুতেই তারা জার্নালিজমের বাংলা সাংবাদিকতাবাদ থেকে “বাদ” ব্যাপারটিই বাদ দিয়ে দিয়েছেন
আর একটি মজার ব্যাপার আছে। সাংবাদিকতা যারা চর্চা করেন তাদের নিজেদের নাম-পরিচয় খেয়াল করেন। এইটা তো আমরা সবাই জানি, বিজ্ঞান যে চর্চা করেন ইংরেজিতে তাকে বলে সাইন্টিস্ট, এর বাংলা বিজ্ঞানী।
সাইন্টিফিক শব্দের অর্থ করা হয়েছে বৈজ্ঞানিক (বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় বা বিজ্ঞান সম্মত), যেমন বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড। একই ধারায় অর্থাৎ জার্নালিস্টিক- এর বাংলা হতে হতো “সাংবাদিক”, যেমন উনি জার্নালিস্টিক প্রোজ বা সাংবাদিক-গদ্য ভাল লিখেন। কিন্তু তা না হয়ে “জার্নালিস্ট” শব্দের বাংলা হয়েছে “সাংবাদিক”।
বাংলাভাষায় শুরুতে তা ছিল না, সংবাদ নিয়ে যারা কাজ করতেন তাদের নামপরিচয় ছিল “সংবাদী”, এর নারীরূপও ছিল- সংবাদিনী। কিন্তু বাংলা না জানা ইংরেজ পণ্ডিতরা ইংরেজি না জানা সংস্কৃত পণ্ডিতদের সাথে বসে এই “সাংবাদিক” জন্ম দিয়েছেন৷
এই দুই কথা তোলার কারণ হচ্ছে, এই কথা স্মরণ করা যে, বাংলাভাষার সাংবাদিকরা সব সময় পর ভাষায় ঝোল খেয়েছেন এবং ফলত প্রায় সব কিছুই ইচ্ছে মতো বুঝেছেন, বুঝাতে চেয়েছেন।
কিন্তু সত্য তাতেও লুকিয়ে থাকে, একটু চোখ খুললেই সেই সত্য চোখে পড়ে। যেমন, আজকাল কেউ যখন বলেন “আমি সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে বলছি” তখনই বুঝবেন উনি সাংবাদিকতার ছত্র বা ছাতাধারী। সুতরাং যে দিকে সুবিধা সেই দিকে ছাতা ধরার অধিকার তিনি রাখেন।
নইলে, আজকের যুগের মানুষ যেখানে স্পষ্ট করে জানে রাষ্ট্র আর সরকার দু’টি পৃথক ধারণা তখন তারা বারবার “রাষ্ট্র” কথাটাকে সমানে রাষ্ট্র করতে চান কেন? কেন তারা সাংবাদিকতার আলাপে রাষ্ট্রকে সামনে টেনে আনেন। সাংবাদিকতার সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ততোটুকু যতটুকু সম্পর্ক রাষ্ট্রের অন্য তিন অঙ্গের বা বিভাগের।
আইন বিভাগের কাজ হচ্ছে আইন নিয়ে কাজ করা, বিচার বিভাগের কাজ হচ্ছে আইন অনুসারে বিচার করা এবং সরকারের কাজ হচ্ছে আইন আর বিচার বিভাগের নির্দেশনা পালন করে সরকার পরিচালনা করা।
আর সাংবাদিকতা, যাকে রাষ্ট্রের চতুর্থ অঙ্গ বা বিভাগ বলা হয় তার কাজ হচ্ছে সরকার, আইন ও বিচার বিভাগকে জনগণ যে ক্ষমতা দিয়েছে সেই ক্ষমতা চর্চাকে ঠারে ঠারে রাখা আর সেই সব ক্ষমতাকে তাদের ক্ষমতা চর্চার এখতিয়ার ও সীমা সম্পর্কে সচেতন করিয়ে দেওয়া, জনগণের পক্ষ থেকে সব প্রশ্নের উত্তর আদায় করে জনগণকে জানানো।
আপনার কি মনে হয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ছাত্ররা এ কথা জানেন না? ঠিকই জানেন। কিন্তু দুষ্টুরা আসলে নিজেদের “সাংবাদিকতার ছত্রধারী” অর্থে “সাংবাদিকতার ছাত্র” পরিচয় দেন, ধরেই নেন জনগণ বুঝতে পারবে না ।
লেখক- শিক্ষক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
( সূত্র- ৩এপ্রিল,২০২৩ এ প্রকাশিত সাংবাদিক জোবায়ের চৌধুরীর টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত )
গ:মা:/স:/জ:নি: ০৩/০৪/২০২৩
পাঠকের মন্তব্য