রাজনীতি সংযোগ । এ্যড. শফিউল আজম
অতি সম্প্রতি সোহরাওয়াদী উদ্যান,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা উত্তর দক্ষিন,সিলেট,রাজশাহী চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলা ছাত্রলীগের কর্মসুচী,নেতৃবৃন্দের কর্মতৎপরতা, মিছিল বক্তব্য ইত্যাদি দেখে আমি খুবই আনন্দিত, স্মৃতিকাতরতায় মুগ্ধ এবং অতি আশান্বিত।ছাত্রলীগের বর্তমান সাদ্দাম-ইনান নেতৃত্বকে আন্তরিক ধন্যবাদ।১৯৭৪ সনের ১৭ ফেব্রুয়ারী,ঢাকায় ছাত্রলীগের পুনর্মিলনীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন–”আমি দেখতে চাই আমার ছাত্রলীগ যেন ফার্স্ট ক্লাস বেশী পায়,তারা যেন নকল করে পাশ করার বিরোদ্ধে আন্দোলন করে। ” বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জন্মলগ্ন থেকে মেধাবী ছাত্রদের সংগঠন ছিল।দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, পেশাজীবি সর্বত্র ছাত্রলীগের মেধাবীদের নিয়ন্ত্রন ছিল।মেধাবী ছাত্র না হলে সে কখনো ছাত্রলীগের ভাইটাল পোস্টের নেতাতো দুরের কথা, কমিটির সদস্য হওয়ার সাহসও করতনা।একবার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখুন, দেশের শীর্ষ রাজনীতিকরা কোননা কোন সময় সবাই ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিল।দেশের শীর্ষ কবি সাহিত্যিক,ডাক্তার, আইনজীবি,ইঞ্জিনিয়ার, আমলা, সাংবাদিকরা প্রায় সবাই ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিল। আজকের এ সময়ে এসে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে অনেকের,এমনকি স্বয়ং ছাত্রলীগের সিংহভাগ নেতাকর্মীদেরও।
দেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িত এ সংগঠনের মুলনীতি,জাতির প্রতি কমিটমেন্ট, জনগনের প্রতিটি ন্যায্য আন্দোলনে তার সক্রিয় অংশগ্রহন, দাবী আদায়, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপোষহীনতা; সংগঠনকে বাংলার জনগণের মনের মনিকোটায় স্থান করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে শত শত কালজয়ী, ইতিহাস সৃষ্টিকারী নেতা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে ওঠে এসেছেন। ভাষা আন্দোলন,সামরিক সরকার বিরোধী আন্দোলন,যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন,শিক্ষা আন্দোলন, ছয়দফা, এগার দফা আন্দোলন,গণ অভ্যুত্থান,মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সবকিছুতেই ছাত্রলীগের অগ্রবর্তী ভুমিকা। ছাত্রলীগ ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন আন্দোলন কিংবা ভাল কিছু সৃষ্টি হয়নি।ছাত্র জীবনের প্রায় পুরোটা অংশই এ মহীরুহ ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম বলে এখনো গর্ববোধ করতে পারি সর্ব মহলে, রাজনীতি কিংবা সামাজিক অঙ্গনে।
স্বাধীন বাংলাদেশের রুপরেখা,জাতীয় পতাকা,জাতীয় সংগীত নির্বাচন, মুজিব বাহিনী,নিউক্লিয়াস সবকিছুর স্রষ্টা ছাত্রলীগ। জন্মলগ্ন থেকে মেধাবী,চৌকষ, দেশপ্রেমিক ছাত্ররাই এ সংগঠন করেছে। অছাত্র কুছাত্র, ব্যাকবেন্চার কখনো এ সংগঠন করার সাহস করেনি।বাংলার মুক্তিকামী জনতার অহংকারের মধ্যমনি ছিল ছাত্রলীগ। ইহুদীরা যেমন ছদ্মবেশে বিভিন্ন আসমানী ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ঢুকে ধর্মের মৌলিকত্ব নষ্ট করেছে করছে, তেমনি ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগের মধ্যেও উন্নয়নবিরোধী,দেশদ্রোহী, স্বাধীনতাবিরোধীরা অনুপ্রবেশ করে ধর্মনিরপেক্ষ গণমুখী,রাজনীতির এ মাদার সংগঠনকে নীতিভ্রষ্ট কলুষিত করে ধ্বংস করে চলেছে নিরবে প্রতিনিয়ত। রাজনৈতিক নেতা তৈরীর এ কারখানা এখন অনেক দুষ্ট শ্রমিকে ভরে গেছে। এ কারখানা তার উৎপাদিত নষ্ট পন্যের কারনে সাংগঠনিক নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাতে কয়েকবার লে- অপের সম্মুখীন হয়েছে। ঘোষনা দিয়ে বন্ধ রাখতে হয়েছে সংগঠনের কার্যক্রম। যে সংগঠনের মুলনীতি শিক্ষা,শান্তি,প্রগতি সে সংগঠনের নেতা কর্মীদের বিরোদ্ধে যখন অভিযোগ ওঠে শিক্ষা বিমুখতার, শান্তি বিনষ্টের কিংবা পশ্চাদমুখীতার,স্থবিরতার তখন নিরব মনোকষ্ট বিস্তার লাভ করে। মাঝে মাঝে তাদের অনেক ভাল কাজ দেখে এখনো যেমন আনন্দে উদ্বেলিত হই, তেমনি গড্ডালিকা প্রবাহে তাদের গা ভাসানো দেখলে যারপরনাই হতাশার বিষাদে আক্রান্ত হই।
বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা। বঙ্গবন্ধু যেটা বলতেন ছাত্রলীগ তা বাস্তবে পরিনত না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরতেন না।ছাত্রলীগ কখনো কোন নেতার লেজুড়বৃত্তি করেনি।ছাত্রলীগের ঐক্যবদ্ধ যৌক্তিক দাবীর কাছে গণসংগঠন আওয়ামী লীগ অনেক সময় তার নীতি কৌশল বদলাতেও বাধ্য হয়েছে।ছাত্রলীগকে অনৈতিক কিংবা ব্যক্তি স্বার্থের পক্ষে কেউ ব্যবহার করতে সাহস করেনি।বরং ছাত্রলীগের ন্যায্য দাবীর পক্ষে রাজনৈতিক দল বা নেতারা একাত্মতা ঘোষনা করতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৪ সালের ৩১ আগষ্ট ছাত্রলীগের মহাসমাবেশ ও সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষনা দিয়েছিলেন –”স্বাধীনতার শত্রুরা আর কোনদিন বাংলার ক্ষমতা দখল করতে পারবেনা.। বাংলাদেশকে স্বনির্ভর, উন্নত ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিনত করা হবে। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর জন্ম, তোমাদেরকে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ করতে হবে, তাঁর আদর্শ বুকে ধারন করার মধ্য দিয়ে। “কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেদিনের সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত ছাত্রলীগ কিংবা পরবর্তী কমিটির ছাত্রলীগ নেতারা বঙ্গবন্ধু-কন্যার বাণীর মর্মার্থ অনুধাবনে এবং ছাত্রলীগের ঐতিহ্য ধারনে কিংবা মুলনীতি লালনে সম্পুর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু কন্যা উপলদ্ধি করেছিলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মানের ভবিষ্যত টেকনিশিয়ানরা হচ্ছে আমাদের ছাত্রলীগ।তাই তিনি নিজ হাতেই সদ্য বিদায়ী কমিটিতে নেতৃত্ব বাছাই করে দিয়েছিলেন। অর্থের কিংবা লবি-সিন্ডিকেটের বিনিময়ে ছাত্রলীগে নেতৃত্ব সৃষ্টির অশুভ তৎপরতা তিনি বন্ধ করে জাতির ভবিষ্যত কান্ডারীদের চরিত্রের সুরক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, মাননীয় নেত্রীর মিশন ভিশন কোনটাই ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা বুঝতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ,রাজনীতির লক্ষ্য,ডিজিটাল বাংলাদেশ কনসেপ্ট, সেক্যুলারিজম,বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, শোষনমুক্ত গণসম্পৃক্ত অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দীক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে স্টাডি ছিলনা বললেই চলে তাদের। সর্বক্ষেত্রে মেধাবী,যোগ্য,চৌকষ হওয়া দুরে থাক,রাষ্ট্র পরিচালনা দুরে থাক,অন্তত ন্যুনতম মেধায় নিজেদের পরিবার ঘর সংসার সমাজ পরিচালনার প্রস্তুতিও তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। সেক্ষেত্রে বর্তমান কমিটির সাদ্দাম-ইনান নেতৃত্বের প্রতি আমি অনেকটা আমি আশাবাদী। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা কিংবা জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বনির্ভর উন্নত ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানের পথে তাদের তারুন্যের উচ্ছাস ও স্বপ্নকে বর্তমান আওয়ামী নেতৃত্ব কাজে লাগাতে পারলে দেশ ও দলের জন্য মঙ্গল।
দেশে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, উচ্চ শিক্ষায় অনেক সমস্যা আছে,ছাত্রদের বহু সমস্যা আছে, শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা পদ্ধতিতে সমস্যা আছে,শিক্ষা-বানিজ্যগত সমস্যা আছে, সবকিছুর ব্যাপারে ছাত্রলীগের কর্মসুচী থাকা চাই।আশা করি বর্তমান ছাত্রলীগ তার কাজে কর্মে, কর্মসুচীতে, আচরনে,জনগনের সমস্যা সমাধানে স্বাধীনভাবে কাজ করে ঐতিহ্য ফিরানোর চেষ্টা করে যাবেন এবং প্রকৃত রাজনীতিক হওয়ার সদিচ্ছা নিয়ে ছাত্রলীগকে বুকে ধারন করবেন।
নীতির পুজা বাদ দিয়ে যারা ভাইয়ের পুজা নেতার পুজায় ব্যস্ত, চরিত্র গঠনের চেয়ে চরিত্র বিসর্জনে যারা মত্ত, চাঁদাবাজি,ধান্ধাবাজি,ঠিকাদারী,দখলবাজিতে যারা নিয়োজিত, মাঠে ময়দানে কোন কাজ না করে সর্বক্ষন নেতার ড্রয়িংরুমে হাজিরা দিতে যারা অভ্যস্ত,ইঁচড়ে পাকা বডিশো,ফেইসশো এর নায়করা তাদের দ্বারা অন্তত আর যাই হোক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা কিংবা শেখ হাসিনার ডিজিটাল স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজ হবেনা। এর জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষিত,প্রশিক্ষিত, নিবেদিতপ্রান, জাতির প্রতি কমিটেড, সেক্যুলার কর্মীবাহিনী।জননেত্রী শেখ হাসিনার বাছাই করা বর্তমান ছাত্রলীগ নেতৃত্বের প্রতি আমাদের অগাধ আস্থা এবং বিশ্বাসের মর্যাদার প্রতিফলন দেখতে চাই। তাদের কর্মসুচীতে ছাত্রলীগের সোনালী ঐতিহ্যের আলোকচ্ছটা দেখতে চাই।ছাত্রলীগ থেকেই উঠে আসুক আগামী দিনের বঙ্গবন্ধু,সৈয়দ নজরুল তাজউদ্দিন,কামরুজ্জামান, মনসুর আলী, শেখ হাসিনা, মতিয়া চৌধুরী,সাজেদা চৌধুরী,আমির হোসেন আমু,তোফাইল আহমেদ,রাজ্জাক,সুরঞ্জিত,সিরাজ আরেফ,নুরে আলম,মাখনরা এ প্রত্যাশা চিরদিনের।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দের প্রতি অনুরোধ, ছাত্রলীগকে কার্যকর ফলপ্রসু নেতৃত্ব সৃষ্টির কারখানা হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে আপনাদের সুদৃষ্টি আন্তরিকতা ঢেলে দিন এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্র থেকে জেলা উপজেলাসহ সকল স্তরের নেতৃত্ব বাছাইয়ে অন্যায় হস্তক্ষেপ নয় আন্তরিক সহযোগিতা করুন।মনে রাখবেন ছাত্রলীগ বাঁচলেই আওয়ামী লীগ বাঁচবে আর আওয়ামী লীগ বাঁচলে দেশ বাঁচবে, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্য থাকবে।জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
লেখক- রাজনীতিবিদ ও সিনিয়র আইনজীবী
(৬সেপ্টেম্বর,২০২৩ তারিখে প্রকাশিত লেখকের টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত)
রা:স:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য