পরিবেশ সংযোগ । মোহাম্মদ আমীন
”আল্লাহ গো, আমি অন্ধ, আমারে কিছু দিন। আল্লাহ গো, দিন না কিছু!” রমনা পার্কে ভিক্ষুক ঢোকা নিষেধ, কিন্তু গিজ গিজ করছে। কিছুদূর পরপর আওয়াজ, “আল্লাহ, আমি গরিবরে কিছু ভিক্ষা দিন। হাঁটুয়ারা যেন আল্লাহ। ঢাকা ভিক্ষুকের শহর। তাই রমনা পার্কও। ভিক্ষাবৃত্তি একটি অপরাধ। তবু ভিক্ষুকের কমতি নেই ঢাকায়। মনে হলো, ভিক্ষুক নিষিদ্ধ না করে ভিক্ষা দেওয়া নিষিদ্ধ করা উচিত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়:
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে তৃণ সম দহে।
প্রথম চক্কর শেষ করার আগে ছয় প্রবীণকে স্বপ্নের রমনা পার্কের স্বপ্ন-লাল ইটের পিচ্ছিল বুকে আছড়ে পড়তে দেখলাম। ছয় বারই ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক; এসব আছাড় আমার ওপর দিয়েও যেতে পারত! বাঁচার জন্য পার্কে এসে মরণ-বরণ। নজরুলের ভাষায়, ‘‘কীসের আশায় করছে তারা, মরণ বরণ যন্ত্রণাকে।” ষাটোর্ধ্ব বয়সে ইটের রাস্তায় আছড়ে পড়া মানে পুরো জীবনটা ভয়ানক কষ্টের অভিশাপে পরিণত হওয়া। আমি রাস্তা ছেড়ে ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। আছাড় খেলে অন্তত হাতপা ভাঙবে না।
কিছুদূর গিয়ে দেখি হাঁটার পথে অর্ধ-গোড়ালি জল। ওখানেও এক প্রবীণকে পড়ে যেতে দেখলাম। এবার সাত। দৌড়ে গিয়ে তাঁকে তুললাম। ভীষণ ব্যথা পেয়েছেন তিনি। হাঁটতে পারছেন না। অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। পার্কে প্রাথমিক চিকিৎসারও কোনো ব্যবস্থা নেই। কেঁদে কেঁদে বললেন, “বাঁচার জন্য হাঁটতে এসে অক্ষম হয়ে গেলাম। বাবারে, আমাকে এখন কে দেখবে? অভিশপ্ত রমনা পার্ক আমার জীবনটা শেষ করে দিল।” জলে ভরে গেল চোখ। এই কষ্ট বিরহের চেয়েও ভয়ানক:
“ছলছল আঁখি মোর
জল ভরা মেঘে যেন ছাওয়া।
জানিনা ফুরাবে কবে
এই পথ চাওয়া।।”
শুধু রাস্তা নয়, পুরো পার্ক আবর্জনায় ভরতি। পার্ক নয় যেন, ঢাকা শহরের সম্মিলিত আঁস্তাকুড়। বুড়োরাও আবর্জনা। হয়তো তাই তাদের হাঁটার স্থান এমন আবর্জনামুখর। কোথায় যাবেন এরা? এক আছড়ে-পড়া প্রবীণের আক্ষেপ, “কোথায় যাব আমরা? যারা পার্কটিকে এমন করে রেখেছেন তাঁরা কি বুড়ো হবেন না কখনো? অবসরে যাবেন না কখনো? আমি তাঁদের অভিশাপ দিচ্ছি।”
হাঁটার পথের অধিকাংশ পিচ্ছিল শ্যাওলার সবুজ-আস্তরে ঢাকা। যেন রাষ্ট্রীয় অতিথির জন্য বিছিয়ে রাখা সবুজ গালিচা। তবে এই গালিচায় পা দিলে শিবরাম চক্রবর্তীর চিৎপটাং। কখন পরিষ্কার করা হয়েছে তা নির্ণয় করতে হলে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা প্রয়োজন। ঢাকা ময়লা-আবর্জনা আর পঁচা শ্যাওলায় ঢাকা। পার্ক এর ব্যতিক্রম হবে কীভাবে?
কী দুঃসহ!
কী অভিশপ্ত! কী ভয়ংকর!
রমনার রমণীয় শরীরে
আজ শকুনের আঁচড়!
লেখক- সাবেক উপ সচিব, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়,বঙ্গভবন ও এডিটর, শুদ্ধ বানান চর্চা ।
(২২সেপ্টেম্বর,২০২৩ তারিখে প্রকাশিত লেখকের টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত)
প:স:/জ:নি: