জানা অজানা । ইকড়ি মিকড়ি ছড়া কাহিনী
“ইকড়ি মিকড়ি চাম-চিকড়ি,
চামের কাঁটা মজুমদার,
ধেয়ে এল দামোদর।
দামোদরের হাঁড়ি-কুঁড়ি,
দাওয়ায় বসে চাল কাঁড়ি।
চাল কাঁড়তে হল বেলা,
ভাত খাওগে দুপুরবেলা।
ভাতে পড়ল মাছি,
কোদাল দিয়ে চাঁছি।
কোদাল হল ভোঁতা,
খা কামারের মাথা।”
ছোটবেলায় আমরা অনেকেই এই ছড়াটি পড়েছি। কিন্তু কখনো কি ভেবেছি নান্দনিক ছন্দের এই ছড়াটির অর্থ কি? এই ছড়া কোন ইতিহাস বয়ে বেড়ায় কিনা? এই প্রশ্ন করলে হয়তো এই উত্তরই আসবে যে শিশুদের নির্ভেজাল আনন্দের জন্য এই ছড়ার রচনা হয়েছে। কিন্তু সত্যটা বেশ করুণ। আদতে আনন্দের ছিঁটেফোঁটাও নেই এই ছড়ায়, শিশুদের জন্য তো না বটেই। মূলত: এই ছড়ায় ছড়াকার অসাধারণ দক্ষতার সাথে চিরন্তন বাংলার সাধারণ মানুষের দুঃসহ আর্থ-সামাজিক অবস্থা তুলে ধরেছেন। চলুন এবার ছড়াটির প্রতিটি শব্দ ও পংক্তি ধরে বিশ্লেষণ করে দেখি।
‘ইকড়ি’ অর্থ সংসার পরিপালনের জন্য সারাদিন খেটেখুটে কঠোর পরিশ্রম করা। কিন্তু তাতেও যখন সংসার চলে না, তখন প্রয়োজন হয় ‘মিকড়ি’, অর্থাৎ আরও কিছু অতিরিক্ত উপার্জনের চেষ্টা করা। ‘চাম’ অর্থ রুজি-রোজগারের এলাকা। আর ‘চিকড়ি’ অর্থ সেই রোজগারের এলাকায় ঘুরে ঘুরে কিছু (অর্থ বা ফসল) উপার্জন করে তা ঘরে নিয়ে আসা।
কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এই “চামের কাঁটা মজুমদার”। ‘মজুমদার’ মূলত এক প্রকার রাজকর্মচারীর পদবী যার কাজ ছিল খাজনা বা রাজস্ব আদায় ও হিসেব রাখা। আর তাই অনেক সময় খাজনা আদায়ের নামে দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে যেত বলে তাকে পথের কাঁটা বলা হয়েছে।
আর অতঃপর “ধেয়ে এল দামোদর”। এই ‘দামোদর’ হলো মূলত ফড়ে-পাইকারের দল, যারা সাধারণ কৃষকের উৎপাদিত ফসল অথবা কুমারের বানানো তৈজসপত্র স্বল্প দামে কিনে নিয়ে বাজারে চড়া দামে বিক্রি করতো।
কিন্তু এই দামোদর শুধু এসেই ক্ষান্ত হয় না। এখানে বলা হয়েছে “দামোদরের হাঁড়ি-কুঁড়ি”। এর অর্থ হলো, তারা যখন আসে তখন সাথে করে হাঁড়ি কুঁড়ি নিয়ে আসে। অর্থাৎ খেটে খাওয়া মানুষের উৎপাদিত সব দ্রব্য সাথে করে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আসে।
এরপর বলা হয়েছে “দাওয়ায় বসে চাল কাঁড়ি”, অর্থাৎ মজুমদার আর ফড়ে পাইকারের থেকে লুকিয়ে যেটুকু চাল বাঁচানো গিয়েছে, এবার সেটা দিয়েই ঘরের দরজায় বসে ভাত রাঁধার প্রস্তুতি শুরু। কিন্তু “চাল কাঁড়তে হল বেলা”, অর্থাৎ এতসব ঝামেলা ঝক্কি সামলাতে সামলাতে ভাত রাঁধায় দেরী হয়ে যায়। তাই “ভাত খাওগে দুপুরবেলা”, অর্থাৎ প্রথম প্রহরে বা সকালে খাওয়া আর সম্ভব হয় না। একেবারে দ্বিপ্রহরে বা দুপুরে খেতে হয়।
কিন্তু খাবে কী করে! কারণ “ভাতে পড়ল মাছি”। এখানে ‘মাছি’ বলতে আসলে চোরকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ গরীবের যে যৎসামান্য খাদ্য, তারও শেষ রক্ষা হয় না। ছিঁচকে চোর সেটাও চুরি করে নিয়ে যায়। তাই “কোদাল দিয়ে চাঁছি”। এই ‘কোদাল’ও আক্ষরিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। বরং কোদাল বলতে এখানে কোতোয়াল বা পুলিশের কথা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশের কাছে গিয়ে চোরের ব্যাপারে নালিশ করা হয়েছে।
তবে তাতেও যে গরীব মানুষের হয়রানি কম হয়, তা কিন্তু নয়। কারণ “কোদাল হল ভোঁতা”। অর্থাৎ পুলিশ বা কোতোয়াল কোন কাজই করে না। আর তাই “খা কামারের মাথা”। অর্থাৎ এই কোদাল যে কামার বানিয়েছে, মানে পুলিশ কোতোয়াল সৃষ্টিকারী গ্রামের উচ্চপর্যায়ের লোকেরা, শেষমেশ তাদের কাছে গিয়েই এই হতদরিদ্র মানুষ গুলোর মাথা কুটে কাঁদতে হয়।
সুতরাং এক কথা বললে, এই ছড়ায় ছড়াকার গ্রাম বাংলার সেই খেটে খাওয়া মানুষের জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন যে কিনা কঠোর পরিশ্রম করেও জমিদার, খাজনা আদায়কারী, অসাধু ব্যবসায়ী, চোর, পুলিশ এদের উপদ্রবে নিজের পরিবারের জন্য দু’ বেলার খাবারও জোটাতে পারে না।
তথ্যসূত্রঃ
১। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী, “বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ”, ভাষাবিন্যাস
২। ড. মোহাম্মদ আমিন, “ইকড়ি মিকড়ি : অসাধারণ অর্থপূর্ণ একটি ছড়া”, ব্লগ পোস্ট
Special courtesy : Folklore Expedition Bangladesh
জা:অ:বি:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য