সাহিত্য সংযোগ । শোভা - আদিত্য অনীক
মেয়ে বিয়াতে বিয়াতে মা যখন ক্লান্ত — তখন আমার জন্ম ৷ আমি বাবা-মা’র চতুর্থ অপকর্ম ৷
ঈশ্বর সবই দিয়েছেন- হাত, পা, নাক, মুখ, চোখ, উরু, জঙ্ঘা, বুক - শুধু শোভা ছাড়া ৷
তাই ক্যাদরানি একজন ডেকে উঠলো “শোভা” বলে ৷ ঐ হয়ে গেল আমার নাম নামপত্র ৷
ছেলের জন্য তর সইছিলো না ৷ বছর বছর বিইয়ে যাচ্ছিলো মা ৷ পিঠা-পিঠি দুই ছেলে হলো ৷
চার বোন সেবাদাসীর মত কাতার দিয়ে দাড়িয়ে গেলাম ৷ দুই ছেলের সেবা যত্নের জন্যই যেন মা কষ্ট করে আগে চার মেয়ে বিইয়েছে ৷
এতদিন বাবা ছিল ” বিউটির বাপ” ৷ ছেলে পয়দা করে রাতারাতি ”বাবলুর বাপ” বনে গেল ৷
ভাইদের উচ্ছিষ্ট ছিল আমাদের খাদ্য ৷ নিরাশ্রিতা বিড়াল ভাগ্য ৷ কোন ছেলে যদি বলতো তরকারিতে লবণ হয় নি তবে বাবা চোখ উল্টে বলতো, এখন উচিত চার শয়তানীকে এক সের করে কাঁচা লবণ খাইয়ে জন্মের মত রান্না শিখিয়ে দেয়া ৷ কথার ঝাঁঝে চার মেয়ের মৃত্যুর আকুলতা হলফল করতো ৷ আমার বুকে এক দুরাশা কলবল করে উঠতো- ইশ্ ফের যদি শুরু করা যেতো পুরুষ জন্ম থেকে ৷
পিঠাপিঠি ভাইটি কোন কারণে কেঁদে উঠলেই বাজের মত ছুটে আসতো মা ৷ ছেলে কাঁদছে এটাই আমার অপরাধের চূড়ান্ত ৷ নাকেমুখে এমন ভাবে কিল আর লাথি মারতো যেন মরে যাই ৷ অন্তত বড় বিপদটা বিদায় হয় ৷ চার মেয়ের মধ্যে আমিই সবচেয়ে কালো আর বেপরোয়া ৷ বড় হয়ে নাকি শুভ্র বংশবদনে কালি মাখিয়ে ছাড়বো ৷
জামার তালি ফেটে বেদনা ঝরে ৷ মেয়ে হয়ে জন্মানোর যন্ত্রনার লাভা বুকের ভিতর গড়গড় করে ৷ উদগীরণ কই ? চোখের লোনা জলে কালশিটে ভিজে ওঠে- করুণাঘন ঈশ্বর তুমি কোথায় ? তুমি কি পুরুষ? নইলে কেন তোমার কানা বিচার ?
ভাই দুটোর প্রতি প্রচন্ড হিংসা হতো ৷ মা যদি ছেলে বিয়াতে না পারতো তবে আমাদের উপর এত লান্নত্ নেমে আসতো না ৷ ওরা যদি হঠাত্ মারা যেতো তবে মায়ের ছেলে বিয়ানোর দম্ভ কোথায় যায় দেখতাম ৷
ছাত্রী হিসাবে মেধাবী ছিলাম ৷ কিন্তু স্কুল পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হওয়া হলো না ৷
বাবার চোখে মেয়েরা দোজখের লাকড়ি ৷ এদের লেখাপড়ায় টাকা খরচ করার চেয়ে মাদ্রাসায় দান করা নেকীর কাজ ৷
ছেলে দুটোর লেখাপড়ায় বিস্তর খরচ ৷ বিষয়ে বিষয়ে টিচার, কোচিং, নানা পদের গাইড ৷ আর আমাদের লেখাপড়া বন্ধ ৷ জিদ্দে বুক ফেটে যেতো ৷ ইচেছ করতো ছেলে দুটোর খাবারে বিষ মিশিয়ে দেই ৷ বাবার বাহাদুরী কই যায় দেখি ৷ ছেলেমানুষ মারার বিষ কোথায় পাওয়া যায় ?
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ পাশ করলাম ৷ বিয়ে হচ্ছে না বলে বাবা-মায়ের কষ্টের সীমা নেই ৷ মনে হতো এবার নিজেই বিষ গিলি ৷ চেষ্টা করে একটা ছেলে জুটিয়ে বাবা-মাকে উদ্ধার করলাম ৷ ছেলে বীমার দালাল ৷ মোষের মত কালো ৷ গরিলার মত লোম ৷ সজারুর পাছার মত খাড়া চুল ৷ মাধবদির কলুদের মত থ্যাবড়া নাকের ফুন্দা দিয়ে ভিতরের প্যাটা পাকানো চুলের উপর চোখ পড়লে গা ঘিনঘিন করে ওঠে ৷ ইচ্ছে করেই মোষটাকে বেছে নিলাম যেন রাস্তার কুত্তীও ওর দিকে ফিরে না তাকায় ৷
মনে মনে খুশি হলেও বাবা মধ্যবিত্তের আকামা তেজে গর্জালো ৷ ”আমার মেয়ে হয়ে এত বড় কলংক করলি ? যা আজ থেকে তোর জন্য আমার দুয়ার চিরতরে বন্ধ ৷” বাবা এক ঢিলে দুই পাখি মারলো ৷
রামপুরার ঘুপচিতে একরুমের বাসা ভাড়া নিলাম ৷ তিন মাসের মধ্যে মোষটা পেটে বাচ্চা ঢুকিয়ে দিলো ৷
বাচ্চা হবার পর সংসারে অনটন বেড়ে গেলো ৷ আগে টিউশনি করতাম ৷ সেটাও বন্ধ ৷ কিছুতেই আর চলছে না ৷ কাতর গলায় বললাম, প্লিজ একটা উপায় কর ৷
সে বলদা চোখ কপালে তুলে বলল, উপায় ? উপায় থাকলে কি আর তোমার মত পেঁচীরে কেউ বিয়া করে ? ইচ্ছা করলো আয়নাটা মুখের সামনে ধরে বলি নিজের চেহারাটা দেখ পেঁচার বাচ্চা ৷
আগে আমার প্রতি তার একটা আকর্ষন ছিল ৷ কার্তিক মাসের কুত্তার মত ঘেঁষাঘেঁষি করতো, জড়িয়ে ধরতো, রাত হলে কাছে আসতো ৷ এখন আর ভাল লাগে না ৷ অন্য মেয়ে দেখলেই ছুক ছুক করে ৷ প্রায়ই শূন্য পকেটে ঘরে ফিরে ৷ শার্টে লম্বা চুল বা লিপস্টিকের দাগ ছাড়াই ওর চোর টাইপ চেহারা দেখেই বুঝতে পারি যেদিন সে বাইরের মেয়েদের কাছ থেকে আসে ৷ মা-মেয়ে তার কাছে আপদ ৷ বিদায় হলে বাঁচে ৷ কিন্তু এই মেয়েকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাড়াবো?
চাকরির জন্য দৌড়-ঝাঁপ শুরু করলাম ৷ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ঘরে বসে যত সহজে মিলে চাকরি তত সহজ না ৷ একট হুয়াইট কলার জবের জন্য আমার কল্পনার কোমল কৃষ্ণচুঁড়া দলিত হলো অনেক পুরুষের বিষের বুলেটে ৷ দু’তিন জায়গায় চাকরি হালোও ৷ কোনটাই টিকলো না বেশি দিন ৷ তাদের নতুন মুখ চাই ৷ পেট ঝোলা ষাঁড়গুলোর এক মাঠের ঘাসে বেশিদিন রুচি থাকে না ৷
পাড়ায় কেজি স্কুল খুলেছে ৷ যিনি মালিক তিনিই হেডমাস্টার ৷ বেতন কম দিতে হয় বলে মেয়ে টিচার নিচ্ছে ৷ হোক কম বেতন ৷ তবু নানা গুয়ে ছুকছুক করা অফিসের কুকুরগুলোর পিছনে ঘুরতে আর ভালো লাগে না ৷ টিচার এর মর্যাদা আছে ৷ ইজ্জত নিয়ে চাকরি করা যাবে ৷
চাকরিটা হয়ে গেল ৷ সদ্য পাশ করা এক ঝাঁক টাইট-ফিট তরুণী টিচার ৷ তবে টিচারগুলো বেশি দিন টিকছে না ৷ হেডমাস্টার বলেন, ঘাড় মোটা হয়ে গেলে তো আর রাখা যায় না ৷
টিচার হবার সুবাদে টিউশনি গতি পেল ৷ ছাত্রদের জন্য আলাদা রুমের দরকার ৷ দুই রুমের বাসা ভাড়া করলাম ৷ স্থায়ী কাজের বুয়া ৷ ঘাত-প্রতিঘাতে জীবন চলে যাচ্ছে ৷
হঠাত্ বিকেলে হেডমাস্টার ডেকে পাঠালেন ৷ শোভা, তোমাকে আর রাখা যাচ্ছে না ৷ কাল থেকে আর আসার দরকার নেই ৷
বুকের মধ্যে বুবুজেলা বেজে উঠলো ৷ চাকরিটা না থাকলে টিউশনিও থাকবে না ৷ মেয়েকে নিয়ে বাঁচবো কী খেয়ে ? ধরা গলায় বললাম, স্যার ৷
হেডমাস্টার আমার দিকে তাকালেন ৷ তার চোখে জ্যামিতিক জরিপের এক্সরে মেশিন বসানো ৷ কামুক দৃষ্টি গায়ের নরম জায়গাগুলোতে তীরের মত বিঁধতে লাগলো ৷ একটা চিরকুট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, সন্ধ্যায় এখানে এসো ৷
চিরকুট হাতে আসার আগেই বললাম, জ্বি স্যার ৷
আবছায়া অন্ধকারে আরামবাগের মেস কোয়ার্টার ৷ স্যার রুমের তালা খুললেন ৷ এককোণে হাড়ি-পাতিল আর কেরোসিনের স্টোভ ৷ সিঙ্গেল খাটের উপর তেলচিটে বিছানা ৷ এক্সপার্ট হেডমাস্টার আমার মলাট খোলা গায়ে অভিজ্ঞতার ছাপ্পর মেরে দিলেন ৷
কাজ শেষে বললাম, মেয়েটার জ্বর, স্যার আমি যাই প্লিজ ৷
বসো বসো ৷ এমন নিরিবিলি পরিবেশ তো আর সহজে মিলে না ৷ ওহ্ তোমার তো বাচ্চা আছে ৷
বাচ্চাটা মনে হয় নরমাল ডেলিভারি হয়েছিল ৷ সিজারিয়ান করাতে পারলে না ? নরমাল ডেলিভারি হলে ঢিলা হয়ে যায় ৷ মজা থাকে না ৷
হঠাত্ দরজায় টোকা ৷ একজন এমনভাবে ঢুকে পড়লো যেন সে ঢোকার জন্য তক্কে তক্কে ছিল ৷ তেলাপোকা কালারের ক্রিমিটাইপ নেড়ি কুত্তা ৷ গায়ে ঢলে পড়ে কথা বলতে লাগলো ৷
আমি জড়োসড়ো হয়ে যেতেই স্যার বললেন, ভয়ের কিছু নেই ৷ উনি রহিম সাহেব, এই রুমটা তারই ৷
খুব আপন মানুষ ৷ ধর আমরা এক মায়ের পেটের ভাই ৷
হেডমাস্টার ভুরভুরা সাপপঁচা গন্ধের মুখটা কানের কাছে এনে বললো, আমি যাই ৷ তুমি আর একটু থাকো ৷ বুঝতো সব ৷ তার মুখটা বন্ধ করে এসো, নইলে প্রেস্টিজ পাংচার ৷
হেডমাস্টার চলে গেলেন ৷ তেলাপোকাটা দরজা বন্ধ করে ফিরে তাকালো ৷ ঐ পিচাশ চাহনি চিনি ৷
ধর্মঘটী শরীরের নিরেট পাথর বিষের ছোবলে নীল ৷
রাতে জ্বরে অচেতন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছি ৷ ঘুম নেই ৷ শিউরে উঠছে শরীরটা থেকে থেকে ৷
যারা নিকটাত্মীয় ছিল তারা মুখ ফিরিয়েছে ৷ ছিল এক দুর সম্পর্কের ঈশ্বর- সেও পুরুষের দলে ৷ অন্ধকারে পুরুষ মানুষগুলোর মুখ একে একে ভেসে উঠছে মনের ক্যানভাসে ৷ বুকের ভিতরে সাপক্রিমিশকুনের দংশন ৷ মনের মধ্যে জিঘাংসার আগুন ৷ তাবত্ ঘৃণা আর থু এই পুরুষজাতটার জন্য বুকের মধ্যে দলা বেঁধে আছে ৷
ইচ্ছে করছে ফুসলিয়ে একে একে বাসায় নিয়ে আসি ৷
তারপর ম্যাগাজিন সহ অস্ত্রটা বটি দিয়ে কেটে কুত্তার মুখে পুরে দেই৷
সেটা সম্ভব নয় ৷ কারণ মেয়েটার ওপাশে একটা পুরুষ জানোয়ার শুয়ে আছে ৷
একটু বাদে জানোয়ারটা ভাববে আমি ঘুমিয়ে গেছি ৷
তখন চুপচাপ ওঠে চোরের মত রান্না ঘরে যাবে ৷
ওখানে কাজের বুয়া শুয়ে আছে ৷
———————————————————————–
লেখক : প্রকাশক ও স্বত্বাধিকারী, আদিত্য অনীক প্রকাশনী,বড় মগবাজার, ঢাকা।
(২৯অক্টোবর,২০২৩ তারিখে প্রকাশিত লেখকের টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত)
সা:স:বি:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য