গণমাধ্যম সংযোগ । নিয়ন মতিয়ুল
দেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী করে তরুণদের তৈরির পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংকুচিত। ভালো গবেষণা, মৌলবিজ্ঞান চর্চা, উদ্ভাবন, কর্মসংস্থান নিয়ে বহুমুখী পরিকল্পনা নেই। শিক্ষাক্রম তৈরিতে ভালো শিক্ষাবিদের প্রচণ্ড অভাব। ঘুষ আর রাজনৈতিক প্রভাব ব্যতীত ভালো শিক্ষক নিয়োগে আগ্রহ নেই। যেসব অদম্য তরুণ এতশত প্রতিকূলতা সঙ্গী করেও গবেষক বা বিজ্ঞানী হয়ে উঠছেন, তারা প্রায় সবাই দেশ ছাড়ছেন। উন্নত দেশে গিয়ে বিস্ময়কর গবেষণা, উদ্ভাবন আর মেধার স্বাক্ষর রাখছেন। দেশ তাদের উপযুক্ত মূল্যায়ন বা কাজের পরিবেশ দিতে পারছে না।
এক সমীক্ষা বলছে, দেশে শিক্ষিত তরুণদের প্রায় অর্ধেক বা ৪২ শতাংশই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে চান। অনিশ্চিত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, দক্ষতা অনুযায়ী চাকরির বাজার তৈরি না হওয়া, গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের স্বল্পতা, উদ্ভাবন আর উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগের অভাব এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় তারা বিদেশে পাড়ি জমাতে আগ্রহী। বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টারের ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে ২০২৩’ শীর্ষক সেই যৌথ সমীক্ষায় জীবিকা, জলবায়ু পরিবর্তন, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সুশাসন, তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিপ্রায় বিষয়ে তরুণদের আকাঙ্ক্ষা আর উদ্বেগ- দুটোই উঠে এসেছে। (সূত্র: বণিকবার্তা, ১৭.১১.২০২৩)।
বলতে কি, যেসব মেধাবী তরুণ দেশে বিভিন্নখাতে কর্মরত তারা চারপাশের অসুস্থ, দূষিত কর্মপরিবেশে নিজেদের অভিযোজিত করতে গিয়ে হয় মূল্যবোধ হারাচ্ছেন, নয়তো মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এসবের পেছনে যে রাজনীতির দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। বিদ্যমান রাজনীতি দশকের পর দশক ধরে হিংসা, সহিংসতা, ঘৃণার বীজ বপন করে চলেছে। দলগুলো পরস্পরকে প্রতিরোধ করতেই সব শক্তি, মেধা ক্ষয় করছে। জ্ঞানভিত্তিকসমাজ বিনির্মাণে বৈশ্বিক যে দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন জরুরি সে বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার সক্ষমতা কমে আসছে দলগুলোর।
মূলত, প্রচলিত অসুস্থ রাজনীতি উন্নত রুচি তৈরি, অসাম্প্রদায়িক মনন ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে একেবারেই অক্ষম। বিশ্বমানের নতুন প্রজন্মের বিকাশে অবদান রাখায় একেবারে পেছনের সারিতে। দেশীয় শিল্পখাতের চাহিদার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সিলেবাসের কোনো সমন্বয়ই নেই। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারদের উপচে পড়া ভিড় থাকলেও দক্ষ জনবলের সংকটে ভুগছে শিল্পখাত। ফলে রিজার্ভ ক্ষয় করে বিদেশি এক্সপার্টদের ভাড়া করতে হচ্ছে। অথচ উন্নত-সুস্থ-স্বাস্থ্যকর জীবন ব্যবস্থার টানে আমাদের এক্সপার্ট আর ট্যালেন্টরা গণহারে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
রাজনীতির মূলধারাই সবচেয়ে বেশি নষ্ট আর কলুষিত করছে নতুন প্রজন্মকে। রাজনীতির নামে যে আদর্শহীনতা, মেধাহীনতা, বন্যতা, ঘৃণা, হিংস্রতার চর্চা চলছে তা কখনই মূলধারার ঐতিহ্যকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম নয়। বর্তমান ছাত্ররাজনীতিতে আদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের গভীরতা নেই। বিশ্বাস আর যুক্তির পার্থক্য করতে পারছে না তারা। এমন কাঠামোর বদল না ঘটলে আগামী শত বছরেও দেশীয় রাজনীতির এই চরিত্রের বদল যে ঘটবে না তা শতভাগ নিশ্চিত।
আমাদের প্রিয় সন্তানদের মধ্যে যারা বর্তমানে দেশীয় রাজনীতির পঠন-পাঠনে ব্যস্ত তারা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে খাপ খেয়ে নেয়া আধুনিক জটিল বৈশ্বিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশের পাঠোদ্ধারে আগ্রহী নয়। আর সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, বস্তাপচা বহুলচর্চিত বয়ানে আমাদের গণমাধ্যমগুলো রাজনীতির আবর্জনা দূর করার পদ্ধতি প্রয়োগে শুধু দুর্গন্ধই ছড়িয়ে দিচ্ছে।
লেখক- News Editor at দৈনিক আনন্দবাজার
(১৮ নভেম্বর,২০২৩ তারিখে প্রকাশিত লেখকের টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত)
গ:মা:স:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য