সংযোগ খবর । রাজনীতি
বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বহু নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় ভোটের লড়াইয়ে বিভিন্ন আসনে নৌকা মার্কার মূল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাদের দলের নেতারা। বিএনপি অংশ না নেওয়ায় ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন’ দেখাতে আওয়ামী লীগের এ কৌশল এখন দলের মনোনীত এবং জোটের প্রার্থীদের অনেকের জন্য ‘মাথাব্যাথার’ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী এবং জোটের নেতারাও স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে তাদের সমস্যার বিষয়টি এখন সামনে আনছেন। দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরাও আশংকা করছেন, ভোটের লড়াই থেকে সৃষ্ট বিরোধ সারাদেশে দলের ‘অভ্যন্তরে স্থায়ী’ বিরোধ ও বিভেদের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমসহ মোট ১০ জনের মনোনয়ন বৈধ হয়েছে।
এই ১০ জনের মধ্যে চারজনই আওয়ামী লীগ নেতা। সিংগাইর ও হরিরামপুর উপজেলা নিয়ে মানিকগঞ্জ-২ আসনটিতে আওয়ামী লীগের তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন -দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু এবং সিংগাইর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুশফিকুর রহমান খান হান্নান। স্বতন্ত্র প্রার্থী সবাই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।
একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে মুশফিকুর রহমান খান হান্নান বিবিসি বাংলাকে বলেন, তিনি ২০০৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৯ সালেও তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। “আমার জনগণ আমাকে নির্বাচন করার কথা বলেছে এবং তারা আমার সাথে আছে। কাজেই আমার সরে দাঁড়ানোর কোনো যুক্তিই নাই,” বলেন মি. খান।
মি. হান্নান বলছেন, এতে বিভেদের কিছু নেই। তবে তিনি স্বীকার করেন বিএনপি নির্বাচন করলে এতো বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতো না। এদিকে একই আসনে প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল বলেন, দলের অনাপত্তি থাকাতেই তিনি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছে। প্রার্থীতা প্রত্যাহারের চিন্তা আপাতত করছেন না।
“আমি যে প্রার্থী হয়েছি এটাতো দলীয় সিদ্ধান্তের কারণেই। যে আমরা নির্বাচন করতে পারি এবং করলেও দলের কোনো আপত্তি নাই। এমন কথা বলা হয়েছে, কেউ যদি হেভিওয়েট প্রার্থীকে হারাতে পারেন তাহলে আমরা সাধুবাদ জানাবো।” “নির্বাচন কমিশন যেভাবে কাজ করছে এবং বলছে যে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের সর্বাত্মক চেষ্টা করবে, তাতে আমাদের আসনে অন্তত আমি মনে করি কোনো সংঘাত বা সমস্যা হবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. আরেফিন।
নির্বাচনী বিরোধ একটি স্থায়ী বিভেদ তৈরি হতে পারে কি না এ প্রশ্নে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল বলেন, এটি সারাদেশেই হতে পারে। কারণ এমপি হওয়ার একটা প্রতিযোগিতা রয়েছে নেতাদের মধ্যে। যারাই রাজনীতি করেন সবারই লক্ষ্য এমপি হওয়া।
দল থেকে কোনো আপত্তি না থাকায় বিভিন্ন আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোটের লড়াইয়ে জোরালো প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিছু আসনে দলীয় প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এগিয়ে আছেন বলেও অনেকে মনে করছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়টি আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী এমনকি দলীয় প্রার্থীরাও ভালো চোখে দেখছেন না।
মানিকগঞ্জ দুই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম ধারণা করছেন, প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষে গিয়ে হয়তো এ বিষয়ে একটা সমাধান হবে। তিনি মনে করেন, একই আসনে স্বতন্ত্র এবং নৌকার প্রার্থীদের মধ্যে একটি ‘স্থায়ী বিরোধ’ সৃষ্টি হতে পারে এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। “আমরা চাই না দলের মধ্যে কোনো বিশৃঙ্খলা হোক। দলের নেতারা এদিক-সেদিক গেলে দলের মধ্যে কিছু কর্মী থাকে তারা পথভ্রষ্ট হয়। এবং আগামীতে সেগুলো অন্যান্য ভোটেও কিন্তু খুবই একটা প্রভাব ফেলে” “নিজেদের মধ্যেও একটা দলাদলি সৃষ্টি হয়, মন কালাকালি সৃষ্টি হয়, অমিল সৃষ্টি হয়। এটাকে আবার এক জায়গায় নিয়ে আসাটা কিন্তু খুব কষ্টের বিষয় হয়ে যায়,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মমতাজ বেগম।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের স্পষ্ট ঘোষণা হলো এবার কেউ বিনা ভোটে নির্বাচিত হতে পারবে না। আর ভোটার উপস্থিতিও বাড়াতে হবে সারাদেশে। কোনো আসনে বিরোধী কোনো প্রার্থী না থাকলে প্রয়োজনে ‘ডামি প্রার্থী’ দাঁড় করা এবং ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। দলীয় হাইকমান্ডের এই ঘোষণার সুযোগ পেয়ে দেখা যায় বেশিরভাগ আসনেই নৌকা মার্কার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়িয়ে গেছেন, যারা আওয়ামী লীগ নেতা। কিছু কিছু আসনে একাধিক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে।
এবার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিতরা সংসদ সদস্যরা যেমন আছেন তেমনি স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী কিংবা পরিচিত নেতাও রয়েছে। এসব স্থানীয় নেতারা অনেকে নৌকার প্রার্থীদের ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, এবার ৭৪৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন যেটি অতীতের সব নির্বাচনের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগেরই কমপক্ষে ৪৪২ জন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে আগ্রহ দেখান। প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে অবশ্য ৭৪৭ জনের মধ্যে থেকে ৩২৪ জনের মতো স্বতন্ত্র প্রার্থী টিকে আছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেশি হবে বলেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ছাড় দেয়ার ঘোষণা দিলেও নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করা আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র পরিপন্থী। এ প্রশ্নে আওয়ামী লীগে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ. ফ. ম. বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, দলের প্রয়োজনে, দলের স্বার্থে, দেশের স্বার্থেই তো গঠনতন্ত্র।
“আওয়ামী লীগের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র পরিচালিত হয় পরিচালনা করা হয়। আমরা দলের গঠনতন্ত্রের স্বার্থের পরিপন্থী এবং দেশের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজই তার অবস্থান থেকে কখনো করেনি এবারো সেটি করবে না,” বলেন মি. নাসিম।
ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ মনোনীত এবং স্বতন্ত্র নেতাদের বর্তমান এ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। তবে এখনো স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ থেকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেনি। যারা দলীয় মনোনয়ন পাননি তা কি ‘ফ্রি স্টাইলে’ নির্বাচন করতে পারবেন নাকি দলীয়ভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হবে?
মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, এটা তাদের ‘ইলেকশন স্ট্র্যাটেজি’ বা নির্বাচনী কৌশল। “এটা তো ওপেনলি আমাদের সভানেত্রী বলে দিয়েছেন। একাধিকবার তিনি বলেছেন, ওই সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন নুতন করে হয়নি,” বলেন মি. কাদের। এদিকে বিএনপি ছাড়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এবার সারাদেশে ‘নৌকা মার্কার’ সাথে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাই মূখ্য হবে এমন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
সংযোগ সূত্র: বিবিসি বাংলা/প্রকাশ:০৮/১২/২০২৩/রা:স:বি:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য