শিক্ষা সংযোগ । মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
ইংরেজি ‘ডক্টর’ শব্দটি মূলত ল্যাটিন ভাষার। এর অর্থ হলো ‘শিক্ষক’ বা ‘প্রশিক্ষক’। মধ্যযুগের দিকে ইউরোপে যারা ল্যাটিন ভাষা পড়াতেন, তাদের একটি লাইসেন্স লাগতো, যার নাম ছিলো ‘Licentia Docendi’, এবং এই লাইসেন্টিয়া ডোসেন্ডির ইংরেজি অনুবাদ হলো ‘License to Teach’, অর্থাৎ শেখানোর লাইসেন্স। এ লাইসেন্সটিকে ডাকা হতো ‘Doctoratus’, যার ইংরেজি হলো ‘Doctorate’, এবং এ লাইসেন্স যার থাকতো, তাকেই বলা হতো ডক্টর, আর ডক্টর মানে হলো শিক্ষক!
তখনকার দিনে ডক্টর ছিলেন চার্চের মোল্লারা, যারা বাইবেল পড়াতেন ও ব্যাখ্যা করতেন। চার্চের অনুমতি ছাড়া কেউ ‘ডক্টরেট ডিগ্রি’ বা ‘শেখানোর লাইসেন্স’ পেতেন না। কিন্তু খ্রিস্টানদের পোপ ১২১৩ সালে ঘোষণা করলেন যে, আজ থেকে চার্চের পাশাপাশি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ও শেখানোর লাইসেন্স বা ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে পারবে। এই ঘোষণার আগেও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাথোলিক চার্চের অনুমতি নিয়ে কিছু ছাত্রকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিতো। কিথ এলান তাঁর ‘Changing doctoral degrees: an international perspective’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, পৃথিবীর প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রিটি দেয়া হয় ১১৫০ সালের দিকে, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে।
তখনকার দিনে খ্রিস্টানদের এই ডক্টরেট ডিগ্রির মতো আরেকটি ডক্টরেট ডিগ্রি মুসলিমদেরও ছিলো। এটির নাম ছিলো ইযাজাহ। ডক্টরেট দেয়া হতো খ্রিস্টানদের চার্চ থেকে, আর ইযাজাহ দেয়া হতো মুসলিমদের মাদ্রাসা থেকে। কিন্তু দুটিরই অর্থ ছিলো এক: শেখানোর লাইসেন্স। যার ডক্টরেট ও ইযাজাহ আছে, তিনি শিক্ষকতা করতে পারবেন।
তবে অধ্যাপক জর্জ মাকদাইসির মতে, ডক্টরেট ডিগ্রির প্রচলন ঘটেছে মুসলিমদের ইযাজাহ ডিগ্রির অনুকরণে। এ কথা তিনি তাঁর ‘Scholasticism and Humanism in Classical Islam and the Christian West’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। মাকদাইসি ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
সতেরো শতকের দিকে, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই ডক্টরেট ডিগ্রি বা শিক্ষকতার লাইসেন্সের একটি নাম দিলো ‘Doctorate of Philosophy’ বা PhD (Philosophiae Doctor), এবং বাংলাদেশের বহু পাগল এই ‘Philosophy’ শব্দের অর্থ করে থাকে দর্শন! কিন্তু এই ফিলোসোফি সেই ফিলোসোফি নয়। ডক্টরেট অব ফিলোসোফিতে যে-ফিলোসোফি শব্দটি আছে, তা মূলত গ্রীক ভাষায় শব্দটির মূল অর্থকে নির্দেশ করে। অর্থটি হলো: Love of Wisdom বা জ্ঞানের প্রতি মোহ। অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, ও পদপদবী নয়, যে-ব্যক্তির জ্ঞানের প্রতি মোহ জন্মেছে, সে-ব্যক্তিই পিএইচডি! কিন্তু আমি দেখছি, ছাগলেরাও ইদানিং দলবেঁধে পিএইচডি নিচ্ছে।
ফিলোসোফি শব্দটি ব্যবহারের পেছনে অন্য কারণও আছে। ইউরোপে তখন ইতিহাস, গণিত, দর্শন, সামাজিক বিজ্ঞান, ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সকল বিষয়কে একত্রে ফিলোসোফি বলা হতো, এবং এখন যেটিকে ‘কলা অনুষদ’ বা ‘ফ্যাকাল্টি অব লিবারেল আর্ট’ বলা হয়, সেটি মূলত ‘ফ্যাকাল্টি অব ফিলোসোফি’ নামে পরিচিত ছিলো। এ জন্য কেউ দর্শনে ডক্টরেট না করলেও, তার ডক্টরেট ডিগ্রিকে ‘ডক্টরেট অব ফিলোসোফি’ বলা হতো। সংক্ষেপে তারা এটিকে লিখতো:Dr. Phil.
তবে কিছু কিছু জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ডক্টরেটগুলিকে দর্শনের ডক্টরেট থেকে আলাদা করার জন্য ‘Doctor Rerum Naturalium’ বা ‘Doctor of Natural Sciences’ শব্দগুচ্ছটির ব্যবহার শুরু করে। এটিকে সংক্ষেপে লেখা হয়: Dr. rer. nat., এবং একইভাবে, কেউ সামাজিক বিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট করলে লেখা হয় Dr. rer. pol., আইন বিষয়ে করলে লেখা হয় Dr. jur. ইত্যাদি। সুতরাং জার্মানিতে যা Dr. Phil বা Dr. rer. nat. বা Dr. jur., ইংরেজি বিশ্বে তা PhD বা DPhil; বিষয় যা-ই হোক না কেন।
ঊনিশ শতকের দিকে আমেরিকায় আরেক ধরণের ডক্টরেট ডিগ্রির প্রচলন ঘটে। এগুলোকে বলা হয় পেশাগত বা প্রোফেশোনাল বা ভোকেশোনাল ডক্টরেট ডিগ্রি। এদের একটি হলো ‘Doctor of Medicine’, যার ল্যাটিন নাম ‘Medicinae Doctor’, সংক্ষেপে লেখা হয় M.D., এবং আরেকটি হলো ‘Juris Doctor’ বা J.D.। এমডি হলো চিকিৎসা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি, যা আমেরিকানরা ধার করেছে মূলত স্কটল্যান্ড থেকে, এবং জেডি হলো আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি। এ ডিগ্রিগুলো আমাদের এমবিবিএস ও এলএলবির সমান, কিন্তু দুটোই ডক্টরেট ডিগ্রি।
এই অনেক ঘরানার ডক্টরেট ডিগ্রির একটি হলো গবেষণামুখী ডক্টরেট বা রিসার্চ-ডক্টরেট, এবং পিএইচডি বলতে গড়-মানুষেরা এখন এটিকেই বুঝে থাকে। গড়-মানুষদের ধারণা, এটিই একমাত্র পিএইচডি ডিগ্রি, এবং এ ডিগ্রি যার আছে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। সাংবাদিক ও প্রোপাগান্ডিস্ট ডক্টরেটদের অনেক অবদানের একটি হলো এটি। প্রবন্ধটির শিরোনামে আমি যে-ছাগলদের কথা বলেছি, সে-ছাগলেরা পিএইচডির ধারণা তাদের থেকেই রপ্ত করেছে, এবং এ ডিগ্রি অর্জনে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে সর্বশক্তি নিয়ে।
কে পিএইচডি পাবে ও কে পিএইচডি দেবে, এ নিয়ে পৃথিবীতে খুব বেশি আলোচনা হয় নি। এ প্রসঙ্গে আমি একটু ভিটগেনস্টাইনের কথা বলতে চাই। ভিটগেনস্টাইনের সুপারভিশনে ক্যামব্রিজে একটি ছাত্র পিএইচডি করছিলো। তার থিসিসের বিষয়বস্তু ছিলো— ‘লিগ অব নেশনস বা প্রাক্তন জাতিসংঘ কেন ব্যর্থ হয়েছিলো’।
ছাত্রটি একদিন ভিটগেনস্টাইনকে জানালো— এ বিষয়ে আসলে আমার মৌলিকভাবে কিছু বলার নেই। আমি যা থিসিসে লিখবো, তা ইতোমধ্যে অনেকেই বলে গেছেন। পিএইচডির খাতিরে হয়তো একটি মোটা থিসিস লেখা হবে, কিন্তু এটি কোনো জ্ঞান উৎপাদন করবে না। শুধু লেখার জন্যই এটি লেখা হবে।
ভিটগেনস্টাইন বললেন, থিসিস লেখার দরকার নেই, তোমার যে এ উপলব্ধিটুকু হয়েছে, শুধু এ জন্যই তোমার একটি পিএইচডি পাওয়া দরকার। আমি তোমাকে পিএইচডি ডিগ্রি দেবো।
পৃথিবীর অধিকাংশ পিএইচডিই এখন কেবল ডিগ্রি নেয়ার উদ্দেশ্যে করা। জ্ঞানের কোনো শাখায় এসব ডিগ্রির তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান নেই। এগুলোর প্রায় সবই অন্যের কাজের পুনরুক্তি ও অনাবশ্যক এক্সটেনশন। এরকম পিএইচডি এক লাখ উৎপাদিত হলেও সভ্যতার কোনো উপকার হয় না।
এখানে আমি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। ভিটগেনস্টাইন বিএ পড়ার সময় যে-থিসিসটি লিখেছিলেন, সে-থিসিসটি বই আকারে বেরিয়েছিলো। সে-বইটিকেই ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর পিএইচডি থিসিস হিশেবে বিবেচনা করেছিলো, এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের সুপারিশে তাঁকে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়েছিলো। বাংলাদেশে ছাত্ররা এখন যে সাজিয়ে গুছিয়ে থিসিস লিখে ও প্রিন্ট করে, তা পল ডিরাক দেখলে নিজের থিসিসটিকে তিনি খালে ফেলে দিতেন।
বহু পিএইচডিপ্রত্যাশী এখন থিসিসের বাঁধাই ও মলাট দিয়ে এর বিষয়বস্তু ঢেকে রাখতে চান। তারা জানেন যে, এটির ভেতরে কিছু নেই, এটি কিছু শূন্যের সমাহার। এর পাতায় পাতায় ফুটনোট। এর পাদটীকা, অর্থাৎ পায়ে টীকা আছে, কিন্তু কপালে কোনো টীকা নেই। এটি কোনো জ্ঞান উৎপাদন করে নি, এটি পড়লে মনে কোনো আলোর বিচ্ছুরণ ঘটবে না। এটি সবজি ক্ষেতে গজানো বিরক্তিকর ঘাস; যা মাঝে মাঝে ছাগল এসে খেয়ে যায়।
তাই এটিকে ঢেকে রাখতে হবে সুন্দর মলাট দিয়ে, বাঁধাই করতে হবে উৎকৃষ্ট কারিগর দিয়ে। মানের যখন অবনমন ঘটে, সৌন্দর্য তখন মুখ্য হয়ে ওঠে। মানহীনতা ঢাকতে পিএইচডি শ্রমিকেরা আশ্রয় নিচ্ছেন ভালো মানের কাগজ, ভালো মানের প্রিন্ট, ও ভালো মানের মলাটের। এ পরিশ্রমটুকুর জন্যই তাদের পিএইচডি দেয়া হচ্ছে।
এটি যে মুদ্রিত আবর্জনা, এটি যে কেরোসিনের সলতে, তা ওই পিএইচডিপ্রত্যাশী ও তার সুপারভাইজর জানেন। তারপরও এটিকে তারা প্রকাশ করেন। এটিই তাদের জীবিকা। সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ময়লা সাফ করে জীবিকা নির্বাহ করেন, আর এই পিএইচডি শিল্পীরা ময়লা উৎপাদন করে রুটির সংস্থান করেন। সম্প্রতি আফ্রিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বয়স ও ক্ষমতায় তার চেয়েও বড় এক বুড়ো ছাত্রকে পিএইচডি দান করে রুটি হাতিয়ে নিয়েছেন। ছাত্রটিও খুশি। কারণ, তার কোনো কিছুর অভাব ছিলো না; শুধু নামের আগে একটি ড-এ ডট সে লাগাতে পারছিলো না। তার এ অভাব ঘুচে গেছে।
চুরির অপবাদ একসময় দখলে ছিলো গ্রামের সিঁধেল চোরদের; কিন্তু চোরদের অতীত গৌরব এখন ডক্টরেটদের দখলে। সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয় এমন দুই চোরকে গৌরবজনক শাস্তি প্রদান করেছে। তারা চুরি করেছিলো এক বিখ্যাত মনীষীর লেখা। অভিনয় করতে করতে তাদের এমন উন্নতি হয়েছে যে, তারা এখন ফুকো, রাসেল, রুশো, বার্কলে, বার্গসন, হেগেল, কান্ট, হিউম, হবস, ও সাঁত্রের চরিত্রে অভিনয় করছে। এ প্রতিভা নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়।
কিন্তু শাস্তি যাদের প্রাপ্য ছিলো, তারা না পেয়ে পেলো আহাম্মকেরা। আহাম্মক দিয়ে যে গবেষণা হয় না, তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বুঝতে রাজি নয়, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও পরিচালিত হচ্ছে অভিজ্ঞ আহাম্মক দ্বারা। এক পাল আহাম্মক দেখাশোনা করছে আরেক পাল আহাম্মকের, এ এক ট্র্যাজেডি।
বুলবুল কবির নামের একজনকে মনে পড়ছে, তিনি ভোলাগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ বিভাগের শিক্ষক। ২০১৫ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি পান, কারণ খুব শ্রমসাধ্য একটি পিএইচডি থিসিস তিনি লিখেছিলেন (কোনো কাজের ৯৮ শতাংশ নকল করা সত্যিই শ্রমসাধ্য ব্যাপার)।
মুশকিল হলো, থিসিসটি একদিন সুইডেনের গোটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোনাস নিলসনের নজরে আসে। নিলসন দেখতে পান, বুলবুল কবির নামের খাটি বাঙালি শিল্পীটি তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রায় হুবহু মেরে দিয়েছেন, এবং ভাগিয়ে নিয়েছেন পিএইচডি! ক্ষুব্ধ নিলসন ভোলাগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জনাব সোবহানাল্লাহকে চিঠি লিখে এর বিচার চান। বিচারক হিশেবে উপাচার্য সোবহানাল্লাহর সুখ্যাতি কে না জানে?
বুলবুল কবিরকে চাঁদের আলো নামক একটি পত্রিকা জিগ্যেস করেছিলো, কেন আপনি এমনটি করলেন? বুলবুল কবির জবাব দিয়েছিলেন, কোনো গণ্ডগোল হয়ে থাকলে তার দায়ভার আমার সুপারভাইজর ও ভোলাগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের; এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। পরে একদিন চাঁদের আলো ভোলাগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে যায়, এবং বুলবুল কবিরের থিসিসটিকে খুঁজে বের করে। তারা দেখতে পায়, কে বা কারা যেন বুলবুল কবিরের শিল্পকর্মটিতে বেশ ঘষামাজা ও সংযোজন-বিয়োজন করেছে! গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক মো. জয়নব আলির বক্তব্য ছিলো এরকম: “অতি সম্প্রতি ফাইজুল মোহাম্মদ বুলবুল কবীরের পিএইচডি অভিসন্দর্ভে কিছু ঘষামাজা আমাদের নজরে এসেছে। চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠায় কেউ অবৈধ প্রক্রিয়ায় এই কাজটি করেছেন। ঘটনার তদন্ত প্রয়োজন।”
বুলবুল কবিরের সুপারভাইজর ছিলেন অধ্যাপক বদিউস সামাদ আবু। আবু সাহেব কি তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেছিলেন? তিনি কি সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর বুলবুল কবিরকে জানিয়েছিলেন কাকে বলে গবেষণা? সম্ভবত না। গবেষণা তাদের মুখ্য বিষয়বস্তু ছিলো বলে মনে হয় না। তাদের লক্ষ্য ছিলো— কীভাবে কয়েক হাজার শব্দ এক করে কিছু বাক্য লেখা যায়, এবং তা ছাপিয়ে ভাগিয়ে নেয়া যায় পিএইচডি। বুলবুল কবির এ কাজে দারুণ সফলতা দেখিয়েছেন, এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি গবেষণাকর্মে কতোটা ব্যর্থ, তাও দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। বুলবুল কবিরকে আমি অভিনন্দন জানাই।
পিএইচডির সাথে মানুষ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
বরং কেউ কেউ, অপ্রয়োজনীয়ভাবে পিএইচডি নিতে গিয়ে ছাগলে পরিণত হতে পারেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ছাগল শব্দটি এ অঞ্চলে বিবর্তিত হয়ে গেছে। এটি আর ছাগলদের দখলে নেই। ছাগলের মাংস, এমনটি আর বাজারে শোনা যায় না। শোনা যায়— খাসির মাংস, বকরির মাংস। রেস্তোরায় গিয়ে এখন আর কেউ বলে না, আমি ছাগলের মাংস দিয়ে ভাত খাবো। মানুষের একটি অংশ, ছাগল শব্দটিকে নিজেদের করে নিয়েছে। ছাগল শব্দটি শুনলে বা দেখলে, তারাই এখন প্রতিক্রিয়া দেখায়। তারা ভাবে, মনে হয় আমাকে বললো! জবাব দিয়ে আসি!
অপ্রয়োজনীয় পিএইচডি হলো সেগুলো, যেগুলো অর্জনের পেছনে কোনো একাডেমিক কারণ নেই। আছে সামাজিক কারণ। বাংলাদেশে অনেকেই পিএইচডিকে এখন বিবেচনা করছেন সামাজিক মর্যাদা লাভের হাতিয়ার হিশেবে। কেউ হয়তো এমন একটি চাকুরি করছেন, যেখানে পিএইচডির কোনো প্রয়োজনই নেই। কিন্তু তিনি উতলা হয়েছেন পিএইচডি নেয়ার জন্যে। তার শখ হয়েছে, নামের আগে একটি ‘ডক্টর’ লাগানোর। বাঙালির এমন মনোভাব মূলত তার চারিত্রিক হীনম্মন্যতাকেই প্রকাশ করে। সামাজিক মর্যাদার সাথে যে ‘ডক্টর’ শব্দটির কোনো সম্পর্কই নেই, এটি বুঝতে তারা নারাজ। আমি উপরে ‘ডক্টর’ শব্দটির অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখিয়েছি যে— ডক্টরেট ডিগ্রি আসলেই কোনো সামাজিক মুকুট নয়। এটি একটি প্রয়োজনীয় একাডেমিক ডিগ্রি।
কিন্তু ছাগলদের কাছে এটি সামাজিক মুকুট! তাদের দাবি, এটি না থাকলে নামটি একটু লম্বা করে বলা যায় না। এটি তাদের শিং! কিছু পরিস্থিতিতে, তারা এ শিং দিয়ে নিজেদেরকে রক্ষা করে থাকে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ, এটিকে শিং হিশেবে গ্রহণ করেছে। কোনো বিষয়ে আবুল এবং ডক্টর আবুল, এ দুইজন একই কথা বললে, ডক্টর আবুলের কথাকেই ছাগলসমাজ বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাঙালির কোনো অনুষ্ঠানে, মোহাম্মদ জব্বার ও ডক্টর মোহাম্মদ জব্বারের গুরুত্ব এক নয়। ডক্টর মোহাম্মদ জব্বারের দিকে মানুষ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
কিছু জব্বার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টেক্কা দেয়ার জন্য পিএইচডি নিচ্ছে! তারা বুঝাতে চাচ্ছে, আমরা তাদের চেয়ে কম কিসে? আমাদেরও ডক্টরেট আছে!
ইদানিং ওয়াজ মাহফিলের বক্তারাও এ যুদ্ধে শামিল হয়েছেন। তারাও দলবেঁধে পিএইচডি নেয়া শুরু করেছেন। তারা টের পেয়েছেন, ‘ডক্টর’ নামক মুকুটটি না থাকলে ফতোয়ার ওজন কমে যাচ্ছে, মানুষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। অনেকে হাসাহাসি করছে। মানুষ ধরে নিয়েছে, মাওলানা আশরাফের চেয়ে ডক্টর মাওলানা আশরাফের কথার দাম বেশি! ডক্টর মাওলানা আশরাফ বানোয়াট হাদিস বললেও সেটি সহিহ! তিনি মিথ্যা গল্প বললেও তা সত্য!
যার পিএইচডি আছে, তিনি একজন বিশেষজ্ঞ, এমন ধারণা ভিত্তিহীন। এ প্রসঙ্গে ফাইনম্যানকে মনে পড়ছে। ফাইনম্যান বলেছিলেন, পিএইচডির পরও কেউ গর্দভ থাকতে পারে।
কেউ যদি তার ভেতরের গাধাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তাহলে পিএইচডির তাতে বাধা দেয়ার কোনো সামর্থ্য নেই। সভ্যতা যাদের জ্ঞানের উপর দাঁড়িয়ে আছে, তাদের অধিকাংশেরই পিএইচডি নেই। তবে এ কথা এ যুগে খুব একটা খাটবে না। এই মুহুর্তে পৃথিবীতে যারা বিশেষজ্ঞ আছেন, তাদের অনেকেরই পিএইচডি আছে। আবার অনেকেরই নেই। এটি একটি কাকতাল মাত্র। তবে বাংলাদেশে যাদের পিএইচডি আছে, তাদের নব্বই ভাগই যে বিশেষজ্ঞ নন, সেটি চারদিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়।
আর পিএইচডির কাজ কাউকে বিশেষজ্ঞ করে তোলা নয়। বিশেষজ্ঞ হওয়াটা এখানে ঐচ্ছিক। পিএইচডি এখন গবেষণা করার একটি প্রশিক্ষণ কোর্স মাত্র। এটি একজন ছাত্রকে প্রশিক্ষণ দেয়, কীভাবে কোনো বিষয়ে গবেষণা করতে হবে, কীভাবে অন্যের করা কাজকে ঘেঁটে দেখতে হবে, কীভাবে কোনো বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান সৃষ্টি করতে হবে। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্ডারগ্রাড এবং মাস্টার্স কোর্সেও এ প্রশিক্ষণ কিছুটা দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় ছাত্রটির, কোনো বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়। গবেষণার বিষয়বস্তু ভালো হলে, পিএইচডি থিসিসে কিছু জ্ঞান উৎপন্নও হয়। বিশেষজ্ঞের সাথে মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির কোনো আহামরি সম্পর্ক নেই। যিনি কোনো জ্ঞান সৃষ্টি করেন নি, তিনিও পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে পারেন। এ জন্য পিএইচডি থাকা খুব জরুরি নয়। তবে যিনি যে-বিষয়ে গবেষণা করেন, সে-বিষয়ে তার বিশেষজ্ঞ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, এটি মাথায় রাখতে হবে।
কিন্তু বাঙালি সমাজ ধরে নিয়েছে, যার পিএচডি আছে তিনি মহাজ্ঞানী। আর যার পিএইচডি নেই তিনি কিছুই জানেন না। ছাগলরা এ সুযোগটিই নিয়েছে। তারা ভুয়া পিএইচডির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে প্রকৃত পিএইচডিধারীর চরিত্রে অভিনয় করছে। সমাজের মানুষ এ মনোভাব না পাল্টালে, পিএইচডির সামাজিক ‘মুকুট’ বেঁচে থাকবে, এবং ছাগলদের মাথায় এ মুকুট বিরাজ করতে থাকবে। পিএইচডি নেবেন শুধু তারা, যাদের পিএইচডি দরকার। যারা গবেষণা করবেন, গবেষণা খাতে ক্যারিয়ার গড়বেন, অন্যদের গবেষণা শেখাবেন, অথবা যাদের আত্মবিশ্বাস আছে যে পিএইচডি থিসিসে তারা গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান উৎপাদন করতে পারবেন, কেবল তারাই যেন পিএইচডি ডিগ্রি নেন। এতে বাঁচবে মানুষের জীবনের অনেক মূল্যবান সময়। এ সময় তারা ব্যয় করবে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সুখের পেছনে।
সূত্র: মহিউদ্দিন মোহাম্মদ (লেখক)
বই: আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র’
(‘ছাগল ও তার পিএইচডি ডিগ্রি’, পৃষ্ঠা ১৭৫ - ১৮২ থেকে)
জ্ঞানকোষ প্রকাশনী কর্তৃক পরিচালিত মহিউদ্দিন মোহাম্মদ পেইজ থেকে সংগৃহীত । প্রকাশ :২৮মার্চ, ২০২২
শি:স:বি:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য