সংযোগ খবর । ধর্ম
মুসলিমদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘সদকাতুল ফিতর’, যার অর্থ হচ্ছে ‘ঈদ-উল-ফিতরের সদকা’। বাংলাদেশে এটি ‘ফিতরা’ হিসেব অধিক পরিচিত। ইসলাম ধর্মে এটি ‘যাকাত-আল-ফিতর’ হিসেবেও পরিচিত।
ইসলাম ধর্মের নবী এই ‘ফিতরা’ নারী-পুরুষ এবং ছোট-বড় সবার জন্য নির্বিশেষে বাধ্যতামূলক করেছেন। ইসলামি চিন্তাবিদরা বলছেন, রোজা পালনের সময় কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটে থাকলে তা সংশোধন এবং সমাজের দরিদ্র মানুষ যাতে ভালোভাবে উৎসবে অংশ নিতে পারে সেজন্য এই ‘ফিতরার’ বিধান রাখা হয়েছে।
ফিতরা প্রদান করতে হয় ঈদ-উল-ফিতর নামাজের আগে। ঈদের নামাজের পরে ফিতরা দিলে সেটি ‘সদকা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ইসলামে। সেক্ষেত্রে সওয়াব কম পাওয়া যায় বলে ইসলামের বিধান রয়েছে।
আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফিতরার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে ইসলাম ধর্মে। এই ফিতরার পরিমাণ কত হবে সেটি নির্ধারণ করে প্রতিটি দেশ। পাঁচটি পণ্যের বাজার দরের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর ফিতরার অঙ্ক নির্ধারণ করা হয়।
ফিতরার পরিমাণ কত হবে এবং সেটি কীভাবে নির্ধারিত হবে তা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট দেশের ওপর।
সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আব্দুল আজিজ আল-শেখ বলেছেন, যাকাত-আল-ফিতর খাদ্য হিসেবে দেয়া উচিত। এটি অর্থ আকারে না দেয়ার আহবান জানিয়েছেন গ্র্যান্ড মুফতি।
গ্র্যান্ড মুফতিকে উদ্ধৃত করে সৌদি গেজেট পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ‘যাকাত-আল-ফিতর’ খাদ্য হিসেবে দেয়া ইসলামের নবীর সুন্নত।
তবে সৌদি আরবে ‘যাকাত-আল-ফিতর’ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ সৌদি রিয়েল বা প্রায় সাত মার্কিন ডলার।
তবে বিভিন্ন ইসলামি চিন্তাবিদরা বলছেন, ইসলামে যে পাঁচটি খাদ্য-পণ্যের কথা হয়েছে সেগুলোর বাজার মূল্যের ওপর ভিত্তি করে সমপরিমাণ অর্থ দিলেও চলবে।
যুক্তরাষ্ট্রে ফিতরার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ন্যূনতম ১২ ডলার। অন্যদিকে, ব্রিটেনে সেটি নির্ধারণ করা হয়েছে ছয় পাউন্ড।
বাংলাদেশে ফিতরা
বাংলাদেশে চলতি বছর জনপ্রতি সর্বোচ্চ ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৬৪০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা। এই ফিতরা নির্ধারণ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
ফিতরা নির্ধারণের ক্ষেত্রে পাঁচটি খাদ্য-পণ্য বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে আটা, যব, কিসমিস, খেজুর ও পনির। এসব পণ্যের যে কোনো একটি দ্বারা ফিতরা প্রদান করা যাবে।
বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগ থেকে এই পাঁচটি পণ্যের বাজারমূল্য সংগ্রহ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এরপর এসব মূল্যের ওপর ভিত্তি করে ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বলছে, মুসলমানগণ নিজ নিজ আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী এসব পণ্যের যে কোনো একটি পণ্য বা এর বাজার মূল্য দ্বারা ফিতরা দিতে পারবেন।
বাংলাদেশে এবার ফিতরার হার নিম্নরূপ:
গম বা আটা দ্বারা ফিতরা দিলে ১ কেজি ৬শ ৫০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ১১৫ টাকা দিতে হবে
যব দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩শ’ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ৩৯৬ টাকা
কিসমিস দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩শ’ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ১৬৫০ টাকা
খেজুর দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩শ’ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ১৯৮০ টাকা
পনির দ্বারা আদায় করলে ৩ কেজি ৩শ’ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ২৬৪০ টাকা
ফিতরা কীভাবে পরিমাপ করা হয়?
ইসলাম বিষয়ক লেখক এবং গবেষক শরীফ মুহাম্মদ বলছেন, যে পাঁচটি পণ্যের ওপর ভিত্তি করে ফিতরার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় সেগুলো কথা ইসলামের নবী হাদিসে উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশে একটা সময় ছিল যখন ফিতরা নির্ধারণ হতো পণ্যের সর্বনিম্ন মূল্যের ভিত্তিতে। কিন্তু ১৫ বছর যাবত বাংলাদেশে সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ ফিতরার বিষয়টি নির্ধারণ করা হচ্ছে।
“সর্বনিম্ন মূল্য ধরে ফিতরা দিলেও সেটা আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু প্রতিটি ব্যক্তির উচিত হবে তার জন্য মানানসই এবং যৌক্তিক ফিতরা আদায় করা,” বলেন শরীফ মুহাম্মদ।
‘যাকাত-আল-ফিতর’ হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে খাদ্য দান করা হয়। এটি দান করতে হয় ঈদ-উল-ফিতর নামাজের আগে।’
ইসলামের বিধান মতে, প্রতিটি সচ্ছল মুসলিম ব্যক্তি, যার প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য আছে সেটির উপর ভিত্তি করে ফিতরা প্রদান বাধ্যতামূলক। এটি নিজের জন্য দেবার পাশাপাশি তার ওপর কেউ যদি নির্ভরশীল থাকে তাদের জন্যও দিতে হবে। যেমন – মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান।
একটি পরিবারের কর্তা বা অভিভাবক তাদের নিজের জন্য এবং তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য ফিতরা দেবেন। এটি ইসলামে বিধান।
আবু দাউদ-এর সংকলিত হাদিস গ্রন্থ সুন্নাহ ইবনে মাজাহ্ – তে বলা হয়েছে, “আল্লাহর বার্তাবাহক (ইসলামের নবী মুহাম্মদ) বলেছেন, জাকাত আল ফিতর রোজাদার ব্যক্তিকে যে কোনো ধরনের অশালীন কাজ থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করে এবং তাকে বিশুদ্ধ করে তোলে।”
ফিতরা নির্ণয়ের কিছু নিয়ম নির্ধারিত আছে ইসলাম ধর্মে।
একজন ব্যক্তি তার দুই হাতের তালু একত্রিত করে ধরার পর সেখানে যে পরিমাণ খাদ্য রাখা যাবে সেটি ফিতরা হিসেবে দিতে হবে। এই পরিমাণকে আর্থিক মূল্যে নির্ণয় বা পরিমাপ করা যাবে।
পরিমাপ করার জন্য ‘অর্ধ সা’ এবং ‘এক সা’ মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। একমাত্র গম ও চালের ক্ষেত্রে ‘অর্ধ সা’ এবং বাকি চারটি পণ্যের ক্ষেত্রে ‘এক সা’ নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো ছিল প্রাচীন আরব পরিমাপের একক। পরবর্তীতে এটিকে কেজি ও গ্রামে রূপান্তর করা হয়েছে।
‘অর্ধ সা’ বলতে ১ কেজি ৬শ ৫০ গ্রাম এবং ‘এক সা’ বলতে ৩ কেজি ৩শ’ গ্রাম বোঝানো হয়।
যাকাত ও ফিতরার পার্থক্য
যাকাত ও ফিতরার মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। যাকাতের বিধানের সাথে রমজান বা ঈদের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু ফিতরার সাথে রমজান ও ঈদের বিশেষ সম্পর্ক আছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বছরের অন্য সময়ের তুলনায় মুসলিমরা রমজান মাসে বেশি যাকাত দেন। সম্পদের পরিমাণ যত বেশি থাকে যাকাতের পরিমাণও তত বেশি হয়। কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে বিষয়টি সে রকম নয়। ফিতরা নির্ধারিত একটি অঙ্ক। সঞ্চিত অর্থ কিংবা সম্পদের ওপর ফিতরার পরিমাণ নির্ভর করে না। সম্পদের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে ফিতরার পরিমাণ ওঠা-নামা করে না।
“এক কোটি টাকার যিনি মালিক তার সদকাতুল ফিতরা যতটুকু, দুই লাখ টাকার যিনি মালিক তিনিও একই পরিমাণ অর্থ ফিতরা দেবেন,” বলছিলেন শরীফ মুহাম্মদ।
ফিতরা দেয়া কাদের ওপর প্রযোজ্য?
শরীফ মুহাম্মদ বলছেন, যাদের যাকাত দেবার সামর্থ্য আছে তাদের জন্য ফিতরা দেয়া প্রযোজ্য। অন্যদিকে কারা ফিতরা পাবেন? ইসলামের দৃষ্টিতে যিনি যাকাত পাবার উপযুক্ত তিনি ফিতরা পাবার ক্ষেত্রেও উপযুক্ত হবেন।
“রোজা পালন করার সময় মানুষ এমন কিছু ছোটখাটো ত্রুটিবিচ্যুতি করতে পারে যার জন্য তার রোজাকে মাখরুহ করে ফেলে, যেমন কোনো অশ্লীল কথা বলে ফেলেছে। ফিতরার মাধ্যমে রোজা পরিশুদ্ধ হয়,” বলেন শরীফ মুহাম্মদ।
ফিতরার আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈদের আগে দরিদ্র মানুষের জন্য আহারের ব্যবস্থা করা বা তাদেরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা। যাতে তারা এই অর্থ দ্বারা ঈদের দিন উদযাপন করতে পারে।
সংযোগ সূত্র: বিবিসি বাংলা/প্র: ১০এপ্রিল,২০২৪/ধ:স:বি:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য