গণমাধ্যম সংযোগ । নিয়ন মতিয়ুল
সময়টা গেল বছরের এপ্রিল। টানা তাপপ্রবাহ চলছিল। এর মধ্যেই একদিন সুপার ট্যালেন্ট ভাগনি নওরিনের সঙ্গে ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা’ নিয়ে গল্প। রুমে তখন এসির শীতল হাওয়া। এক ফাঁকে বললাম, এই যে এসিটা দেখছো, যতটুকু ঠাণ্ডা আমাদের দিচ্ছে, ঠিক ততটুকু গরমে পোড়াচ্ছে সে বাইরের মানুষদের। শুনে হতবাক ভাগনিটি বললো, এসি বন্ধ করে দিই, মামা? বললাম, একটা বন্ধ করলে হবে; রাজধানীর লাখ লাখ এসি কে বন্ধ করবে? চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো মামনিটির। এক বছরে আর কথা হয়নি মেয়েটির সঙ্গে।
কদিন আগে তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেই যেতে হলো ভাগনিদের বাসায়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে রাতদিন ব্যস্ত। ওর মা এসে বলল, দেখ, মেয়েটির কাণ্ড, এসিতে সে থাকবেই না। রাতে ড্রইংরুমে ফ্যানের নিচে ঘুমায়। কী অবস্থা শরীরের! শুনে আমি হতভম্ব। মনে পড়লো গত এপ্রিলের কথা। সেই যে বন্ধ করতে চেয়েছিল, তারপর থেকেই সে বর্জন করে চলেছে এসি। বৈশ্বিক উষ্ণতার সঙ্গে মামনিটির প্রাণপণ লড়াই দেখে, নীরবেই দুচোখ ভিজে উঠলো।
২.
মনে পড়লো সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ মেয়েটির কথা। বৈশ্বিক উষ্ণতায় পরিবেশ সুরক্ষার কথা ভাবতে গিয়ে ১১ বছর বয়সেই সে হতাশায় ডুবে কথা বলা আর নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিছুদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে সে বলেছিল, “প্রতিবাদ না করে মনে হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।” মেয়েটির কথা ভেবে কার্বনের প্রভাব কমাতে তার পরিবার বিমান ভ্রমণ বর্জন করে।
২০১৯ সালে গ্রেটা ১৬ বছরের কিশোরী। জাতিসংঘের অধিবেশনে বাঘা বাঘা বিশ্বনেতার দিকে আঙ্গুল তুলে হুংকার ছেড়েছিল, “আপনারা আমাদের স্বপ্ন ও শৈশব হরণ করেছেন। বিশ্বের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। আর আপনারা শুধু অর্থ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গালগল্প করে যাচ্ছেন।”
সেই হুংকারের বছর দুয়েক পর (২০২১) গ্লাসগোতে কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনকে ব্যর্থ বলে হাজার হাজার পরিবেশকর্মী বিক্ষোভে নেমেছিল। সেই বিক্ষোভ সমাবেশে গ্রেটা বলেছিল, “এই জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতারা যতটা না কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে জোর দেন, তার চেয়ে বেশি ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় মনোযোগ দেন। এটা মূলত তাদের জন্য দুই সপ্তাহের ব্যবসায়িক উদ্যাপন।” সেই সম্মেলনকে ‘সবুজ মুছে ফেলার উৎসব’ বলেও কটাক্ষ করেন গ্রেটা।
৩.
মূলত, গ্রেটার সব রাগ গিয়ে পড়েছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ‘জলবায়ুমূর্খ’ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর। ২০১৭ সালে ক্ষমতা নিয়েই ট্রাম্প ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসেন। বলেন, এই চুক্তি মার্কিন অর্থনীতিকে ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ করবে, ‘স্থায়ী অসুবিধায়’ ফেলবে।
২০১৯ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে এক পর্যায়ে গ্রেটার মুখোমুখি হন জলবায়ুশত্রু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তখন গ্রেটা ট্রাম্পের দিকে যে অগ্নিদৃষ্টি হানে তা ধরা পড়ে সাংবাদিকদের ক্যামেরায়। পরে প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘গ্রেটার উচিত বন্ধুদের নিয়ে পুরনো চলচ্চিত্র দেখে তার রাগ কমানো।’ আর গ্রেটার মন্তব্য ছিল, ‘বুড়িয়ে যাওয়া নেতারা তরুণদের পরিবর্তনের কথা সহ্যই করতে পারছেন না।”
শুধুই কি ট্রাম্প, পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজনকে পুড়িয়ে ও কেটে ফেলে গোচারণভূমি করার উদ্যোগ নেয়া ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোও গ্রেটাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছিলেন।
৪.
কিংবদন্তি পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ছিলেন ট্রাম্পের জলবায়ুমূর্খতার কঠোর সমালোচক। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হকিং বলেছিলেন, “জলবায়ু চুক্তি থেকে ট্রাম্পের সরে আসা পৃথিবীকে ধ্বংসের কিনারে ঠেলে দেবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী শুক্র গ্রহের মতো হয়ে যাবে। যেখানে তাপমাত্রা ২৫০ ডিগ্রি ছুঁয়ে যাবে। হবে সালফার বৃষ্টি। মানবজাতির সামনে এখন বড় বিপদ জলবায়ু পরিবর্তন।”
আমাদের প্রিয় ধরিত্রী মূলত, ট্রাম্প আর বোলসোনারোদের মতো পরিবেশবিরোধী, জলবায়ুমূর্খদের হাত ধরেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ট্রাম্প বিদায় নেয়ায় সত্যিই বিপদ কমেছিল পৃথিবীর। তবে সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে জনসমর্থনে এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প। তার মানে তেতে ওঠা ধরিত্রী এবার আগ্নিকুণ্ড হয়ে উঠবে।
জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ করে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে তোলা দেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, জার্মানি, ইরান…। এসব দেশের নেতারা কার্বন নিঃসরণ কমাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে সবার পেছনে। অথচ কার্বন নিঃসরণ না করেও শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে ধরিত্রীকে বাসযোগ্য করার দৌড়ে রয়েছে আলবেনিয়া, ভুটান, নেপাল, প্যারাগুয়ে, আইসল্যান্ড, ইথিওপিয়া ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের মতো দেশগুলো।
৫.
মানবজাতিকে বিলুপ্ত করার প্রলয়কাণ্ডে ব্যস্ত বিশ্বনেতাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে স্টিফেন হকিং পৃথিবীর বাইরে বসতি গড়ার পরামর্শ দিয়ে গেছেন। অসহায় কণ্ঠে বলেছেন, ‘মানুষের ভেতর লোভ ও আগ্রাসন তৈরি হয়েছে। সংঘর্ষ কমার লক্ষণ নেই। সমরাস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম পৃথিবীতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার স্বপ্ন দেখতে হলে মহাকাশে কলোনি স্থাপন করতে হবে।’
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, হকিং যে স্বপ্নের কথা বলে গেছেন, তা কি সাধারণ মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব? না, সেই অতিবিলাসী স্বপ্ন একমাত্র সেসব বিশ্বনেতাই দেখতে পারেন, যারা ধরিত্রীকে আগুনের গোলায় পরিণত করতে প্রতিদিন নতুন নতুন উদ্যোগ নিচ্ছেন। যেখানে সাধারণ মানুষের সেদ্ধ হয়ে মরা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
মূলত, গোটা পৃথিবীতেই রাজনৈতিক নেতারা জনগণকে ভেড়ার পাল ভেবে পরিবেশবিধ্বংসী উন্নয়নের মূলো ঝুলিয়ে দেন। গণমাধ্যমের লোভী কর্তাদের ভরেন পকেটে। প্রাকৃতিক পরিবেশসহ নদী, জলাশয়, বন-অরণ্য, সবুজ গিলে ফেলেন রাজনৈতিক অংশীজনেরা। শুধু জনগণ আর আগামী প্রজন্মের স্বপ্নের কথা ভেবে ভেবে কষ্ট পেয়ে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে আমাদের গ্রেটা আর নওরিনরা।
লেখক পরিচিতি :
গ:মা:স:বি:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য