শিক্ষা সংযোগ বিভাগ / জনসংযোগ .কম / ২৩-০৭-২০২০
জনসংযোগ নিউজের শিক্ষা সংযোগ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে গত ১৬ই জুন,২০২০ তারিখে (এথম খন্ড) প্রকাশ করা হয় । জঙ্গীবাদ ও শিক্ষানীতি সম্পর্কে ২০১৭ সালে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে কিংবদন্তী অভিনেতা জনাব আসাদুজ্জামান নূর (এম,পি) অতি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন । উক্ত বক্তব্যের আলোকে প্রথম খন্ড প্রকাশের পর আজ প্রকাশ হলো এর (দ্বিতীয় তথা শেষ খন্ড) । GPA-5 নির্যাতন প্রসঙ্গে বক্তার সঙ্গে স্থানীয় এক আকাশ ভ্রমনে সরাসরি কথোপকথনের সূত্র অনুযায়ী এ খন্ডে রয়েছে কালের স্রোতে দোদুল্য ভাসমান এক অবিমৃষ্যকারী মায়ের গল্প ।
। আসাদুজ্জামান নূর ।
এক মায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, আমরা একই ফ্লাইটে সৈয়দপুর থেকে ঢাকা আসছিলাম । উচ্ছসিত কুশল বিনিময়ের পর তিনি আমাকে বললেন ; আপনাকে পেয়ে ভালই হয়েছে, আপনি শিক্ষা মন্ত্রীকে গিয়ে বলবেন এইযে আপনারা স্কুলে চারু কারু পড়ানো শুরু করেছেন, এগুলো পড়ে কি হবে ? আমার ছেলে কি জয়নুল আবেদীন হবে ? এছাড়াও আপনারা শরীর চর্চা বাধ্যতামূলক করেছেন এতেও-ত বাচ্চাদের লেখাপড়ার খুব ক্ষতি হচ্ছে । একজন মা যখন তার বাচ্চার শিক্ষা বিষয়ে এভাবে বলছেন তখন আমি বিনয়ের সহিতই তাকে বললাম, আচ্ছা আপনি আপনার বাচ্ছাকে কিভাবে মানুষ করতে চান ? তিনি তখন বললেন- হে লেখাপড়া শিখবে, বড় হয়ে ভাল চাকরী করবে । আমি তখন একটু মজা করেই বললাম, নিশ্চই আমরা সবাই চাই আমাদের ছেলেমেয়েরা ভাল রেজাল্ট করবে, ভাল চাকরী করবে, ব্যবসা করবে, অনেক টাকা আয় করবে । ছেলেমেয়েদের ভাল আয় দিয়ে আমরা বাবা মা যারা আছি তারা নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করব । ছেলেমেয়েরা ভাল আয় করলে আমরা-ত নিশ্চিন্ত ; তাছাড়া ছেলেমেয়েদের খাইয়ে পড়িয়ে লালন পালন করতে আমাদেরও ত অনেক কষ্ট হয়েছে, খরচ হয়েছে ; সেগুলো আবার ফেরত উঠানোরও-ত একটা হিসেব নিকেশের ব্যাপার থাকে তাদের সাথে, তাইনা ?
যাইহোক একথা বলার পর আমি ভদ্র মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আপনি ক্রিকেট খেলা দেখেন ? তিনি উত্তর দিলেন- অবশ্যই, শুধু আমিই নই আমাদের পুরো ফ্যামিলিই ক্রিকেট প্রিয় । তার এই উত্তর শুনে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আপনার প্রিয় খেলোয়ার কে ? তিনি নির্ধিধায় উত্তর দিলেন সাকিব আল হাসান । তখন সে সময়ে আইপিএলের আসরে শাহরুখ খানের কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে সাকিব আল হাসান খেলার আমন্ত্রণ পেয়েছিল । সে প্রসঙ্গ টেনেই আমি তাকে বললাম, আপনি কি জানেন আইপিএলের খেলা খেলে সাকিব আল হাসান কত টাকা পাবে ? তিনি বললেন জানিনা, আমি বললাম প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা পাবে । ত- কথা হচ্ছে কেউ কি কখনও প্রশ্ন করে সাকিব আল হাসান GPA-5 পেয়েছে কিনা ?
আমি তাকে আরও বললাম যে আমাদের সংসদে একজন এমপি আছেন খুব ভাল গান করেন ; তার নাম মমতাজ বেগম । আপনি কি জানেন তিনি কোন ষ্টেজ পারফর্ম করলে কত টাকা নেন ? তিনি বললেন - না আমি জানিনা । শুনে বললাম, আমি জানি কারন তার সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে । ধরুন আপনার সাথে যদি তার খুব ভাল বন্ধুত্ব সম্পর্ক থাকে তাহলেও তিনি পাঁচ লক্ষ টাকার নিচে রাজি হবেননা আর তা না থাকলে দশ লক্ষ টাকা আর যদি বিদেশে নিয়ে যান তাহলে পঁচিশ লক্ষ টাকা । আমি ধরে নিলাম তার সাথে সবারই খুব ভাল সম্পর্ক তাই তিনি সবসময় প্রতি “শো’‘তে পাঁচ লক্ষ টাকা করেই নিচ্ছেন । যদি তিনি মাসে ন্যূনতম দশটি শো করেন তাহলে তার মাসে কত টাকা ইনকাম হয় ? তিনি বললেন পঞ্চাশ লক্ষ টাকা । প্রশ্ন হলো - কেউ কি কখনও তাকে জিজ্ঞেস করেন- মমতাজ বেগম আপনি মেট্রিক পাশ করেছেন কিনা ? আমি তাকে আরও বললাম আমাদের দেশের বিখ্যাত চিত্র শিল্পী প্রয়াত কাইয়ুম চৌধুরীর একেকটি তৈল রঙ্গের পেইন্টিং এর দাম বর্তমানে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা । কেউ ত কখনোও খোঁজ করেনি যে কাইয়ুম চৌধুরী কি পাশ করেছে !
আমার কথা হচ্ছে টাকা পয়সা-ত নানানভাবেই আয় করা যায় তাই বলে যে আপনাকে সবসময় মহাপন্ডিত হতেই হবে এমন-ত কোন কথা নেই । তাই বলে আমি বলছিনা যে লেখাপড়া বন্ধ করে আপনার ছেলে মেয়েকে আপনি ক্রিকেট খেলতে পাঠিয়ে দিন, গানের স্কুলে বা আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দিন । কথা হচ্ছে- মানুষের মেধার বিকাশ নানানভাবে হতে পারে, আমাদের সন্তানদের মাঝে আমরা কখনও সেই সম্ভাবনাগুলোকে খোঁজার চেষ্টা করিনা । আমরা শুধু ক্লাশ, রেজাল্ট, হোম ওয়ার্ক এগুলো নিয়েই আছি । ক্লাসে-ত বড়জোর একজন ষ্টুডেন্ট প্রথম হবে বা একজন দ্বিতীয় ও তৃতীয় হবে । তাই বলে যারা প্রথম দ্বিতীয় বা তৃতীয় হবেনা, তাদেরকে কি আমরা বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দিব ? তাদের দ্বারা কি আর কিছুই হবেনা ? আমি তা বুঝতে পারিনা । আমি নিজেও ত কখনই ভাল ছাত্র ছিলামনা, তাই বলে আমি কি আমার বর্তমান বা ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে গেছে ?
সবশেষে আমি ভদ্র মহিলাকে আরও বললাম, আচ্ছা আপনি আইনষ্টাইনের ছবি দেখেছেন কখনও ? তিনি বললেন - না দেখিনি । আমি তখন তাকে বললাম আইনষ্টাইনকে জগৎসেরা বিজ্ঞানী বলা হয় । তাকে জগতের সেরা পন্ডিতও বলা হয় । তার হাতে সবমসয়ই ছোট একটা ব্যাগ থাকত আর সেই ব্যাগের ভিতরে থাকত ভায়োলিন বা বেহালা । তিনি প্রায়ই অবসর পেলেই ভায়োলিন বাজাতেন । কথা হচ্ছে- এত বড় একজন বিজ্ঞানী, এত বড় একজন পন্ডিত হয়েও তার যদি বেহালা শেখার সময় হয়ে থাকে, বেহালা বাজানোর সময় হয়ে থাকে তাহলে আমরা কি এমন পন্ডিত হয়ে গেছি যে, আমাদের একটু গান করার সময় হবেনা ! একটু কবিতা পড়ার সময় হবেনা ! বা একটা ছবি আঁকার সময় হবেনা !!! আমরা ত আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে সেই সুযোগ দিচ্ছিনা । সেইজন্যই আমি বলছি- আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির যোগসূত্রের বিষয়টি নতুন করে ভাবা দরকার, চিন্তাভাবনা করা দরকার । এই যুগসূত্রটি ছিল একসময়, কি করে যেন আস্তে আস্তে বিলিন হয়ে গেল । তাই আমরা এখন বাচ্চাদেরকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শুধু মুখস্থ করাচ্ছি এবং তাদেরকে অস্বস্তিকর একটা জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছি আর সেকারনেই আজকাল যেসব অনৈতিক ঘটনাগুলো ঘটছে এগুলোও তার একটি বড় কারন বলে আমার মনে হয় । তাই দেশের বিজ্ঞজন, শিক্ষকগণ, মেধাবী ছাত্রছাত্রী যারা আছেন, আমাদের সবার মিলে একটি সম্মিলিত স্বিদ্ধান্ত নেয়া দরকার, যে কিভাবে আমরা এর পরিবর্তন আনতে পারি । ধন্যবাদ ।
উক্ত বক্তব্যের আলোকে জনসংযোগ টিকা -
দেশের শিক্ষা বিষয়ক বিশেষঅজ্ঞদের জাতীয় শিক্ষা বিশেষজ্ঞের মর্যাদা দেওয়া বন্ধ করতে হবে, এবং একইসাথে স্বল্প শিক্ষিত মায়েদেরকেও বাচ্চাদের শিক্ষা জীবন নিয়ে জাতীয় শিক্ষা বিশেষজ্ঞের মত ভাবনা বন্ধ করতে হবে । দেশে একসময় শিক্ষা ও সংস্কৃতির যোগসূত্র ছিল কারন তখন সত্যিকারের জাতীয় শিক্ষা বিশেষজ্ঞগণ ছিলেন দেশে এবং একইসাথে দেশের ঘরে ঘরে অশিক্ষিত মায়েরাও ছিলেন । এইদেশে যতজন মহাপন্ডিত, জ্ঞানী ও গুণীজন জন্ম নিয়েছেন বা বড় হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই কিন্তু উচ্চশিক্ষিত মায়েদের চেয়ে অশিক্ষিত মায়েদের ঘরেই বেশী জন্মেছিলেন কারন সেময় নাড়ীর শিক্ষার অধিকার ছিলনা ;; তাই তখন স্বল্প শিক্ষিত মায়েরা ছিলনা বললেই চলে কিন্তু বর্তমানে নাড়ীর শিক্ষা অধিকার জাগরনের ফলে উচ্চ শিক্ষিত মায়েদের পাশাপাশি ঘরে ঘরে স্বল্পশিক্ষিত মায়েদের সংখ্যা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আর অশিক্ষিত মায়েদের বিলুপ্তি ঘটছে । এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণের ফলে আশা করা যায়, যেভাবে এদেশ থেকে অশিক্ষিত মায়েদের বিলুপ্তি ঘটেছে ঠিক একইভাবে তার চেয়েও দ্রুত গতিতে এদেশ থেকে স্বল্প শিক্ষিত মায়েদেরও বিলুপ্তি ঘটবে এবং ঘরে ঘরে উচ্চশিক্ষিত মায়েরা বিরাজ করবে । সুফলটা আমাদের তখন্ই আসবে, সে পর্যন্ত আমাদেরকে বাধ্যতামূলক অপেক্ষা করতে হবে । এক -কথায় বলতে গেলে বাচ্চাদের স্বাধীন বিকাশের ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষিত ও অশিক্ষিত উভয় মায়েদেরই সাবলীল ভুমিকা থাকে । উচ্চশিক্ষিত মায়েরা সব বুঝে যেমন বাচ্চাদের বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়না ঠিক তেমনি অশিক্ষিত মায়েরাও সব নাবুঝে তাদের বাধা হয়ে দাঁড়ায়না । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে হালের স্বল্প শিক্ষিত মায়েরা, যারা সবার চেয়ে অত্যাধিক বুঝে সবসময় এবং তারা নিজেদের মধ্যেই নিজেরা নিজেদের বাচ্চাদের নিয়েই প্রতিযোগীতা করে ; এমনকি তাদের বেশীরভাগই এই ক্ষেত্রে নিজের শিক্ষিত বরকেও অশিক্ষিত মনে করে তার কথাকেও গ্রাহ্য করতে চায়না, কারন তা করলে অমুক অমুক ভাবীর সামনে মুখ দেখানো যাবেনা, ফলে তাদের এই অবুঝ ও নির্মম প্রতিযোগীতার হাতিয়ার হচ্ছে তাদেরই নিষ্পাপ বাচ্চারা । নিজ বাচ্চাদেরকে নিজের অযোগ্যতা ও অপূর্ণতা পূরণের হাতিয়ার বানানোর পরিণাম কি হতে পারে তা তারা যখন উপলব্ধি করতে পারে তখন অনেক দেরী হয়ে যায় কারন ততদিনে বাচ্চারা মনের মধ্যে অনেক জেদ পুষতে পুষতে পরিণত বয়স আসার আগেই বড়কে যায় বা ম্যান্টালী ডিজার্বড হয়ে যায় । অর্থাৎ স্বল্প শিক্ষিত মায়েরা ও জাতীয় বিশেষ-অজ্ঞরা শিক্ষা ও সংস্কৃতির এই করুণ পরিণতির জন্য প্রধানত দায়ী ।
jsongjugnews@gmail.com
fb.com - @jshongjog
পাঠকের মন্তব্য