জনসংযোগ প্রতিবেদন/জনসংযোগ.কম/অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ/১৩-০১-২০২১
। এম আনিছুর রহমান ।
দেশবরেণ্য মান্যবর শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ ২০১৪ সালে ঢাকা কলেজের ১৯৮৮ ব্যাচ শিক্ষার্থীদের পূণর্মিলনী আড্ডায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন । তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক ও ভবিষ্যত প্রেক্ষাপট, বৃটিশ শাষনচিত্র, প্রবাসীদের দেশের জন্য করণীয়, শিক্ষা ও সময়ের মূল্য জ্ঞান এবং আনন্দ উল্লাসের সাথে অঙ্গিকারের গুরুত্ব বিষয়ে মূল্যবান বক্তব্য প্রদানের পাশাপাশি রসভঙ্গে তোলে ধরেন তিনি কেন রবীন্দ্রনাথ হতে পারেননি ।
শুরূতেই তিনি প্রফুল্ল মেজাজে তোলে ধরেন কবি গুরু প্রসঙ্গ । কবিগুরু দিনে মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমাতেন ফলে তার আশি বছরের জীবদ্দশায় তিনি ঘুমিয়েছেন মাত্র আট বছর, এদিকে অধ্যাপক সায়ীদ স্যার তার আশি বছরের জীবদ্দশায় দিনে আট ঘন্টা করে এযাবৎকাল পর্যন্ত ঘুমিয়েছেন প্রায় বিশ বছর । যদি তিনি কবি গুরুর মত দিনে তিন ঘন্টা ঘুমাতে পারতেন তাহলে আরও বার বছর বেশী লিখতে পারতেন । তাহলে হয়ত তিনি কবি গুরুর সমান পর্যায়ে যেতে পারতেন । জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছেন যে কেন তিনি এই জীবনে রবীন্দ্রনাথ হতে পারেননি । এভাবেই প্রাকটিক্যাল জোক এর মাধ্যমে সম্মানের সহিত তিনি এই বক্তব্যে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরেন এবং আগামী প্রজন্মকে আলস্য ঘুম হতে বিরত থেকে নিজকার্যে বেশী বেশী মনযোগী হওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন । বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে আয়োজকদের সময়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বলেন এবং অতিথি আমন্ত্রন ও তাদের বক্তব্য প্রদান বিষয়ে বাস্তবমুখী হতে পরামর্শ প্রদান করেন ; কারন মানুষের শেষ জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত অতি মূল্যবান হয়ে থাকে । অনুষ্ঠান আয়োজকদের এসব ব্যাপার খেয়াল রেখে অনুষ্ঠান আয়োজন ও অতিথি নির্বাচন করা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন ।
এসময় তিনি প্রবাসী শ্রমিক তথা রেমিটেন্স যোদ্ধাদেরকে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং প্রবাসী প্রফেশনালদের দেশের প্রতি নেতীবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তাদের কঠোর সমালোচনা করেন । প্রবাসী শ্রমিকদের চেয়ে প্রবাসী প্রফেশনালদের দেশের প্রতি আরও অনেক বেশী দায়িত্ব আছে বলে তিনি মনে করেন কিন্তু সে তুলনায় তারা তেমন কোন দায়িত্বই পালন করছেননা । তারা দেশ খেকে সব নিয়েছেন কিন্তু চলে গেছেন প্রবাসে । তারা ভুলেই গেছেন এই দেশের প্রতি তাদের ঋণ আছে ; তারা এও ভুলে গেছেন যে ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করতে হয়, কিছু নিলে কিছু দিতেও হয় । তাই প্রতিটি প্রবাসীর তার আয়ের অন্তত ৩% এই দেশে পাঠাতে হবে হউক তা তার নিজের প্রয়োজনে বা জাতীয় কোন স্বার্থে, অন্তত ডলার পাবে বাংলাদেশ । যদি তা না হয় তাহলে তাদের পাসপোর্ট সিলগালা করে দেয়া উচিত যেন তারা আর কোনদিন এদেশে আসার ভিসা না পায় ।
দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে তিনি বলেন; অসুস্থ রাজনীতির কারনে আমাদের নৈতিক অবস্থা একদম ভেঙ্গে গেছে । আমাদের দেশে দুটি প্রধান পলিটিক্যাল দলের দুজন প্রধান আছেন যাদের হাতে সাংবিধানিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে এবং তাদের মধ্যে সাংবিধানিক ভুলের কারনে একটি অসুস্থ প্রতিযোগীতা এবং সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করছে আমাদের দেশে । ক্ষমতার পাওয়ার লোভ ও যেকোন মূল্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠ থাকার স্বেচ্ছাচারী মনোভাব দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে । যেমন করে হোক যেভাবেই হোক উভয়ই উভয়কে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করছে ।
ঠিক এই অবস্থাটাই হয়েছিল আজ থেকে দুইশত বছর আগে আর বৃটিশরা সেই সুযোগে খুব সহজেই এই ভুখন্ড দখল করে নিতে পেরেছিল । সে সময় সারা ভূখন্ডে নৈরাজ্য চলছিল, মোঘল সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়েছিল । তখন চারিদিকে চোর,ডাকাত,বরগীতে সারা দেশ গিজগিজ করছিল । সেই সময় সেই দুর্বলতার কারনে বৃটিশরা এই দেশটাকে খুব সহজেই দখল করে নিতে পেরেছিল । লর্ড ক্লাইভ উমিচাঁদকে তিন লক্ষ পাউন্ড ঘোষ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কিনে নিল কিন্তু ধূর্ত ক্লাইভ তাকে পরে আর সেই টাকা দেয়নি ফলে উমিচাঁদ পাগল হয়ে মারা গেল । ক্লাইভ এদেশে তিনবার এসেছিলেন । প্রথমবার তিনি সমস্ত ক্রাইম করেছিলেন । তিনি উমিচাঁদের সাথে কন্ট্রাক্টে সাইন করেও টাকা দেননাই, তিনি ওয়াটসনের সাইন জাল করেছিলেন এমনকি মীরজাফরের কাছ থেকে তিন লক্ষ পাউন্ড নিজে ঘোষ নিয়ে তাকে মসনদে বসিয়েছিলেন । সেময় ইংল্যান্ডে তিন লক্ষ পাউন্ড অনেক বড় সম্পদ ছিল ফলে তখন ক্লাইভ হয়ে গেলেন সেদেশে লর্ড ক্লাইভ । এরপরও তিনি এদেশে আরও দুবার এসেছিলেন কিন্তু এরপর আর কোন ক্রাইম তিনি এদেশে করেননি । তিনি সমস্ত বৃটিশ অফিসারদের ঘোষ খাওয়া, নজরানা নেওয়া এমনকি চাকরীর বাহিরে ব্যবসা করাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন, ফলে সেনা বিদ্রোহ হয়ে যায় তার বিরুদ্ধে । তিনি প্রায় দু-শ অফিসারকে গ্রেফতার করে ফেললেন । অসম্ভব রকমের ধূর্ত ছিলেন ক্লাইভ । শেষ পর্যন্ত রফা হল যে বৃটিশ অফিসাররা শুধু একটি ব্যবসা করতে পারবে এদেশে আর তা হল লবণের ব্যবসা যা অন্য কোন ভারতীয়রা করতে পারবেনা । এই লবণ আইন অমান্য আন্দোলন ছিল মহাত্না গান্ধীর জীবদ্দশায় বৃটিশ বিরুধী অন্যতম আন্দোলন ।
যাইহোক ধীরে ধীরে বৃটিশরা এদেশে তাদের সিষ্টেম ডেবলাপ করে জনমনে শৃঙ্খলার আস্থা তৈরি করে ফেলল । বিচ্ছিন্ন কিছু বিষয় ছাড়া বৃটিশরা কোন প্রকার ক্রাইমকে প্রশ্রয় দিতনা; শুধু দারগাদেরকে তারা ঘোষ খেতে দিত কারন দারগাদেরকে দিয়েই তারা দেশ শাষন করত । লর্ড মিকোলে লিখেছেন- আমরা যদি সেদিন প্রমাণ করতে না পারতাম যে আমাদের নৈতিকতা তথা বৃটিশ সরকারের নৈতিকতা সেদেশের সরকারের নৈতিকতার চেয়ে উপড়ে তাহলে আমরা কখনই এত বছর সেদেশ শাষন করতে পারতামনা ।শেষকথা হল: বর্তমানে আমাদের দেশে আবারও সেই নৈতিকতায় ভাটা পড়েছে ।সেই রায়দূর্লভ, সেই উমিচাঁদ, সেই মীরজাফর, জগৎশেঠরা আবার জেগে উঠেছে । যতরকম ক্রাইম সম্ভব এদেশে হচ্ছে আর আমরা তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি এবং বেশ এ্যানজয় করছি, একারনে দেশ তার স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়েছে । তাই আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিৎ দেশটাকে টিকিয়ে রাখা ।
। এভাবেই অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ উপস্থিত ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের মাঝে তার নিজ অভিব্যক্তি তুলে ধরেন । এসময় তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন এদেশ তোমার, এ দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি একটি বেদনা, একটি দায়িত্ব তোমাদের মাঝে আছে ।সেই দায়িত্ব যেন কিছু না কিছু আমরা দেখি, যেন আমরা গর্ব করে বলতে পারি যে ঢাকা কলেজে আমরা সেই ছাত্রদের পড়িয়েছিলাম যারা দেশকে পরিবর্তন করেছে ।
এক নজরে - অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
(জন্ম ২৫ জুলাই ১৯৩৯) বাংলাদেশের একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক। তিনি ষাটের দশকে একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি হিসেবে পরিচিতি পান। সে সময়ে সমালোচক এবং সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবেও তিনি অবদান রেখেছিলেন। তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, যা চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশে ‘আলোকিত মানুষ’ তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ২০০৪ সালে তিনি ‘রামোন ম্যাগসেসে’ পুরস্কার লাভ করেন।
বাংলাদেশে অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০৫ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে। প্রবন্ধে অবদানের জন্য তিনি ২০১২ সালে ‘বাংলা একাডেমি’ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭০-এর দশকে তিনি ‘টিভি উপস্থাপক’ হিসেবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
প্রতিবেদনটি জনসংযোগ.কম এর “শিক্ষা ও সাহিত্য” বিভাগ থেকে প্রকাশ করা হল ।
সূত্র- youtube.com / Abdullah Abu Sayeed - My Speeches & Interviews/Banglavision
jsongjugnews@gmail.com
fb.com- @jshongjog
পাঠকের মন্তব্য