। কাজী আব্দুল হান্নান।
ছাত্রদের বাসে হাফ ভাড়ার দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে অনেককেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তুলতে দেখছি। বিরূপ মন্তব্যও কম হচ্ছে না। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন কি এরা হাফ দেয়? হোটেল রেস্তোরাঁয়, চায়ের দোকানে হাফ দাম দেয় কি না? এমনকি যারা ধূমপায়ী তাদের সিগারেটের দাম জোটাতে বাসের হাফভাড়ার আন্দোলন, এমন কথাও লিখছেন কেউ কেউ।
এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি কথা তুলে ধরা উচিৎ মনেকরেই এই পোস্ট।
আমার শিক্ষাজীবনে একাধিকবার হাফভাড়া কেন্দ্রীক বিতন্ডায় বাস চলাচল বন্ধ হবার পর ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই এটা উল্লেখ করছি।
আমাদের শিক্ষাজীবনে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের প্রথম দশকে প্রায়শই বিভিন্নরুটে ছাত্রদের সাথে সংঘর্ষে সেসব রুটে বাসচলাচল বন্ধ হয়ে যেত। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আপোষ মিমাংসার আগে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা যানবাহন বন্ধ রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরের ঘটনা হওয়ায় শিক্ষকরাও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারতেন না। বাধ্যহয়ে পুলিশ প্রশাসন এবং জেলাপ্রশসন ছাত্রপ্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনায় বসতেন। বাস মালিক সমিতি এবং পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সে সব আলোচনা রীতিমতো আইনিযুক্তি তর্কের পর্যায়ে পৌঁছে যেত। পরিবহন নেতা, প্রশাসন এবং ছাত্রপ্রতিনিধি এই তিনপক্ষের আলোচনায় তাই জানাবোঝার ঘাটতি থাকলে দাবি আদায়ের পরিবর্তে মুচলেকা দিয়ে বের হতে হতো। আর যুক্তিতর্কে সফল হতে পারলে সমঝোতা চুক্তি হত।
শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার প্রশ্নে প্রশাসন এবং পরিবহন পক্ষ তখনকার দিনেও এখনকার মত একই যুক্তি নিয়ে হাজির হতেন। বিপরীতে আমরা ছাত্র প্রতিনিধিরা স্থানীয় বিভিন্ন প্রশাসনিক দূর্বলতা, পুলিশের শৈথিল্য এবং পরিবহন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গাটছড়া বেঁধে জনস্বার্থ বিরোধী কিছু কাজের ডকুমেন্টারি নজির তুলে ধরে তাদের নিষ্প্রভ করে দিতে প্রস্তুতি নিয়েই আলোচনায় যোগ দিতাম।
মূল আলোচনায় আমাদের কয়েকটি যুক্তি প্রাধান্য পেত।
১) অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনা নেয়ার নিজস্ব ব্যবস্থা করার দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। যেসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাস নেই তাদের জন্য বাসের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করা হোক।
২) বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বাস রিকুইজিশন করার সরকারী ক্ষমতা প্রয়োগ করে এলাকার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সকালে ও বিকেলে ছাত্রদের আনা-নেয়ার ব্যবস্থা করা হোক প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
৩) ছাত্রদের নিরাপদ যাতায়াতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে ছাত্রছাত্রীরা যতটা দূরের এলাকা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসে সেখান থেকে প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সব সড়ক সকালে স্কুল কলেজ বসার আগের দু’ঘন্টা এবং ছুটির পরের দু’ঘন্টা যন্ত্রদানব যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হোক। শিক্ষার্থীরা পায়ে হেটে কিংবা সাইকেলে নিজ দায়িত্বে এসব সড়কপথে নিরাপদে স্কুল-কলেজে যাতায়াত করতে পারবে।
৪) ছাত্ররা কারো কাছে হাফ ভাড়া নেয়ার দয়া ভিক্ষা করছে না। অনাবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমতি দেয়া বা নেয়ার অন্যতম শর্ত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আবাসস্থল থেকে বের হয়ে স্কুল কলেজে পৌঁছানো পর্যন্ত রাস্তার অংশে প্রশাসনের। স্কুল-কলেজের ভেতরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। ছাত্ররা সেই নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দাবী করছে মাত্র।
আমরা বলেছি, পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের পূর্বসূরি ছাত্ররাও এই দাবীগুলোই করে এসেছে। সকালে এবং বিকেলে একই সময়ে অফিস আদালতে যাতায়াতের তাগিদ থাকায় সড়ক বন্ধ রাখতে প্রশাসন অপারগতা প্রকাশ করত।
পরিবহন সেক্টরের প্রতিনিধিরাও উভয় পিক আওয়ারের যাত্রী হাতছাড়া হলে সেই রুটে বাস চলাচলের ব্যবসা অর্থহীন বিবেচনা করে বিকল্প ব্যবস্থা চাইতেন। সেক্ষেত্রে নিজস্ব বাসের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার দাবি ছাত্র প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে জোরালো হত। কিন্তু কেউ-ই এর পক্ষে সম্মতি দিতে পারতেন না।
এপর্যায়ে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগকরে দুই বেলার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বাস রিকুইজিশন করে দেবার দাবি সামনে চলে আসতো। আর তাতে মালিক-শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের থাকতো সবথেকে বেশী আপত্তি।
এপর্যায়ে আমি যতগুলো ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নিয়েছি প্রতিবারই লক্ষ্য করেছি প্রশাসনের পক্ষ থেকে বল ফেলে দেয়া হত মালিক পক্ষের কোটে। তখন সমাধানের পথ হিসেবে মালিক প্রতিনিধিরাই আলোচনার টেবিলে হাফ ভাড়ার প্রস্তাব দিতেন। আর সেপ্রস্তাবে নিমরাজি হয়ে আমরা ছাত্রপ্রতিনিধিরা শর্ত দিতাম, ছাত্রদের বিরুদ্ধে এসময়ে যেসব মামলা দেয়া হয়েছে সেগুলো প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত অচলাবস্থা বজায় থাকবে। বাধ্যহয়ে সেইশর্তে সমঝোতা হতো। তবে এই হাফ ভাড়া শুধুমাত্র স্কুল-কলেজ খোলা থাকার দিনগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসাযাওয়ার জন্য প্রযোজ্য হবার শর্ত থাকতো।
আশাকরি এখন যারা ছাত্রদের হাফভাড়ার আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা এই লেখার মধ্যে সে যৌক্তিকতা খুঁজে পাবেন।
লেখক -
অনলাইন ইনচার্জ, দ্য বাংলাদেশ অবজারবার
(২৮নভেম্বর,২০২১ তারিখে প্রকাশিত, লেখকের ভেরিফাইড এফবি পেজ থেকে সংগৃহীত)
গ:স:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য