সংযোগ খবর-অপরাধ/জনসংযোগ.কম/সূত্র- বিবিসি বাংলা/২২-০১-২০২১
। সানজানা চৌধুরী । বিবিসি বাংলা, ঢাকা
বাংলাদেশে সম্প্রতি এক বৃদ্ধা নারীকে তার গৃহপরিচারিকার বেধড়ক পেটানো এবং এরপর লুটপাটের ঘটনা গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। প্রবীণদের দেখভালের জন্য সরকারি বা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যে সেবাগুলো আছে সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এছাড়া এ ব্যাপারে প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব আছে। সেইসঙ্গে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে সমাজে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণার কারণে প্রবীণদের নিরাপত্তা ক্রমশ ঝুঁকির মুখে পড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের প্রবীণরা তাদের শেষ বয়সে পরিবারের সাথেই থাকতে চান এবং সামাজিকভাবে সেটাই হয়ে আসছে। কিন্তু এই বয়স্কদের দেখভালের ক্ষেত্রে গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। িএবং তাদের নিয়োগ দেয়া হয় সম্পূর্ণ আস্থার ভিত্তিতে।
ফারজানা জামান তিনি এবং তার স্বামী দুজনেই চাকুরীজীবী হওয়ায় তার ৮৫ বছর বয়সী শ্বশুড়কে সারাদিন একজন গৃহপরিচারিকার তত্ত্বাবধানে রেখে যেতে হয়। অন্যদিকে তার নিজের মায়ের দেখ-ভাল করছেন খণ্ডকালীন গৃহপরিচারিকা। সম্প্রতি বৃদ্ধা নারীকে গৃহকর্মীর বেধড়ক পেটানোর ভিডিও দেখে এই প্রবীণ দুই সদস্যের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। “এই গৃহকর্মীর ওপরে ভরসা করা অনেকটা অদৃষ্টে ভরসা করার মতো। এজন্য প্রতিনিয়ত টেনশন হয়। আমার ভাইও অফিস চলে যাওয়ার পর আমার আম্মা বাসায় একা থাকেন। তো উনি যখন ফোন ধরেন না তখন কি যে মানসিক চাপে থাকি। আর এই চাপ নিয়েই চলতে হচ্ছে। কারণ কোন উপায় নেই।” বলেন মিসেস জামান। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বাড়তে থাকায় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু এই প্রবীণদের সেবায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং জনবল তেমন গড়ে ওঠেনি।
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ২০% প্রবীণ একাকী থাকেন অথবা স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে থাকেন। এই প্রবীণদের সেবায় সরকারের পক্ষ থেকে বয়স্কভাতা কর্মসূচি, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ও পিতামাতার ভরণপোষণ আইন প্রণয়ন, পেনশন সুবিধা দেয়া হলেও তাদের সার্বিক দেখাশোনায় সরকারিভাবে বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে মাত্র একটি। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা কিছু বৃদ্ধাশ্রম মিলিয়ে খুব অল্প কিছু প্রবীণের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রবীণদের দেখভালের জন্য প্রশিক্ষিত সেবাদানকারীও তেমন নেই। যদিও এই অপ্রতুলতার বিষয়টি মানতে নারাজ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু। “উন্নত দেশে সুযোগ বেশি থাকবেই। কারণ আমার দেশে কয়জন ট্যাক্স দেয়। শুধু সুযোগের কথা বলবেন কিন্তু সরকারের চাহিদা, আইন মানবে না, সেটাও তো হয় না। এগুলো আস্তে আস্তে করা হবে। রাতারাতি তো সব ঠিক হয়ে যাবে না।”
প্রবীণদের এভাবে একাকী ও অরক্ষিত হয়ে পড়ার পেছনে অর্থনৈতিক অগ্রগতি, নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া এবং গ্রাম ছেড়ে শহর বা দেশের বাইরে অভিবাসনকে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সামাজিক এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত বিশ্বগুলো প্রবীণদের জন্য যে নতুন-নতুন সেবা-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, বাংলাদেশে সেক্ষেত্রে সরকারি সুযোগ যেমন সীমিত তেমনি বেসরকারিভাবেও প্রবীণদের নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়নি।
বৃদ্ধ বয়সে সেবা দেয়ার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাদানকারীও নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক তানিয়া রহমান বলেন, ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য বিনিয়োগ না বাড়ালে তাদের নিরাপত্তা অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। এক্ষেত্রে বৃদ্ধাশ্রমকে ঘিরে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলেও তিনি মনে করছেন।
মিস রহমান বলেন, “বৃদ্ধাশ্রমকে এতো নেতিবাচকভাবে দেখা উচিত না। কারণ সবার পক্ষে সেবাদানকারী রাখা সম্ভব না। এখন বৃদ্ধাশ্রমগুলো যদি ডে কেয়ার সেন্টারের মতো হয়, সকাল সন্ধ্যা রাখার ব্যবস্থা থাকে তাহলে এই প্রবীণরা নিরাপদে থাকবেন। কারণ সেখানে চিকিৎসক থাকবে, নার্স থাকবে, এছাড়া নিজেদের বয়সী লোকজনের সাথে তাদের ভালো সময় কাটবে। আবার বাড়ি ফিরে পরিবারের সাথে থাকার সুযোগও হবে।” এক্ষেত্রে সব শ্রেণী এবং পেশার প্রবীণদের কথা চিন্তা করে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ানোর ওপরে জোর দিয়েছেন তিনি।
“হাসপাতাল যেমন সরকারি-বেসরকারি আছে, বৃদ্ধাশ্রমগুলো এমন হতে পারে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা দামী প্রাইভেট বৃদ্ধাশ্রমে রাখবে। যারা একদম গরিব, সরকার তাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থা করবে। এ ব্যাপারে ফান্ড গড়ে তুলবে। যাকাতের ফান্ড বা বিত্তশালীরা দান করতে পারে। আসলে পরিকল্পনা করা গেলে সবই সম্ভব।” বলেন মিস রহমান।
এছাড়া প্রবীণদের বোঝা না ভেবে তাদের ব্যাপারে আরও দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে নীতি ও মূল্যবোধে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন তিনি। এক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের সাথে বিশেষ করে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা আগে নানা নানী, দাদা দাদীর কাছে গল্প শুনতাম। এখনকার বাচ্চারা আর এমন নেই। তারা ভিডিও গেম খেলে। এই পরিবর্তন মেনে নিতে হবে। প্রবীণরা যেন তাদের সমবয়সীদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পান, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।”
jsongjognews@gmail.com / fb.com- @jshongjog
পাঠকের মন্তব্য