ইতিহাস সংযোগ । জনসংযোগ নিউজ । ২০মার্চ,২০২১
এক সময় ব্রিটিশরা রাজত্ব করে গিয়েছে প্রায় অর্ধ বিশ্ব। এখনকার এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া সহ অনেক দেশেরই শাসন ক্ষমতা ছিল ব্রিটিশদের কাছে। আমাদের এই উপমহাদেশেই এক সময় ব্রিটিশরা দাপিয়ে বেড়েছে প্রায় দুইশো বছর। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ব্রিটিশ শাসনের আওতায় থাকলেও এই উপমহাদেশেরই আরেকটি দেশ নেপাল কখনো ব্রিটিশদের উপনিবেশে পরিণত হয়নি। থেকে গেছে ব্রিটিশ শাসনের বাইরে। আসলেই কি তাই? কিন্তু কি কারণে বা কেন ব্রিটিশরা নেপাল দখল করেনি চলুন তা আজ জেনে নেই।
১৭৫৭ সাল, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নেতৃত্বে তখন রবার্ট ক্লাইভ। পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং তার ফরাসি মিত্রকে পরাজিত করে ব্রিটিশরা। এর ফলাফল হিসেবে ইংরেজরা দখল করে নেয় বাংলা। এরপরের ইতিহাসটা শুধু দাসত্বের। কোম্পানি তার অবস্থানকে শক্ত করে। দখলে নিয়ে নেয় বাংলা। এবং এর পরের প্রায় ১০০ বছরে ভারত জুড়ে বিস্তৃত করে তাদের ক্ষমতা।
ঠিক একই সময় কাঠমুন্ডু উপত্যকার উপকণ্ঠে গোর্খার এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজা মাত্র কয়েক মাইল দূরে তার রাজত্ব প্রসারিত করতে ব্যস্ত ছিল। তাঁর নাম পৃথ্বী নারায়ণ শাহ। এবং পরে তিনি আধুনিক নেপালের পিতা হিসেবে পরিচিত হন। তিনি কাঠমান্ডু উপত্যকাসমূহ সহ পার্শ্ববর্তী এলাকার সব ছোট ছোট রাজ্য জয়লাভ করে বপন করেন নেপাল রাষ্ট্রের বীজ।
সেই সময়টায় ভারতীয় উপমহাদেশে কেবল দুটি প্রধান শক্তি ছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং নেপালের গোর্খালি আর্মি। এই দুই প্রধান শক্তি কেউ কাউকে ছাড় দেওয়ার নয় । ক্ষমতা প্রদর্শনে একে অপরের সাথে লড়াইয়ে চলে যায়। ১৮১৪-১৬ সালের অ্যাংলো-গোর্খার যুদ্ধ নামে একটি যুদ্ধও ঘটে যায় তাদের এই লড়াইয়ের কারণে। ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে এই যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পরাজিত হয় গোর্খালীরা। গোর্খালীরা যুদ্ধে পরাজিত হওয়ায় কেবল তাদের চলমান রাজ্য বিস্তার চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়নি, তারা তাদের গৌরব হারিয়ে ফেলে । যা পরে আর তারা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।
তবে ১৮১৪-১৬ সালের যুদ্ধটি দুপক্ষের ঘটা প্রথম যুদ্ধ ছিল না। উভয়পক্ষই এর আগেও পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ছিল। ১৭৬৭ সালে তারা প্রথমবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সেই সময় কাঠমান্ডুর রাজা এবং ব্রিটিশদের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। সেই কারণে গোর্খালি আর্মি আক্রমণ করে কাঠমন্ডুর রাজাকে। ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাঠমন্ডুর রাজাকে সহায়তার জন্য সৈন্য পাঠায়। সেই সময় লড়াইটা হয়ে যায় ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বনাম গোর্খালী আর্মি।
ব্রিটিশ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল ক্যাপ্টেন কিনলক। ক্যাপ্টেন কিনলকের নেতৃত্বে ব্রিটিশরা গোর্খালি বাহিনীর হাতে অপমানজনক পরাজয় ভোগ করে। ১০০০ জনেরও বেশি লোককে হারিয়ে অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায় ব্রিটিশরা। এই ঘটনা “Kinloch এক্সপিডিশন” নামে স্মরণীয় হয়ে আছে ইতিহাসে।
গোর্খালি বাহিনী নেপালের সীমান্ত পূর্ব থেকে সিংহল ও দেরাদুনসহ কাঙ্গরা সীমান্ত। অন্যপাশে পশ্চিম দিকে তিস্তা নদীর তীরে দার্জিলিং ও সিকিম পর্যন্ত তাদের রাজ্য বিস্তৃত করে। পূর্বের পরাজয়ের কারণে ব্রিটিশরা গোর্খালীদের সাথে সংঘাত এড়িয়ে চলতে শুরু করে।
কিন্তু গোর্খালীর সেনাপতিদের নিজস্ব সমস্যা ছিল। তখন জায়গির ব্যবস্থা বলে একটি ব্যবস্থা চালু ছিল তাদের মধ্যে। তাদের সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছিল জায়গির ব্যবস্থার মাধ্যমে। জায়গি র ব্যবস্থাকে বলা হয় অসচেতন পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করা একটি ব্যবস্থা। যার অর্থ হলো নতুন অর্জিত ভূমি থেকে আদায়কৃত কর সেনাবাহিনীকে প্রদান করতে হবে। সেখান থেকে সেনাবাহিনীর খরচ বহন করা হত। রাজকোষ থেকে সেনাবাহিনীর জন্য আলাদা কোন খরচ করা হত না। তাই গোর্খালি বাহিনীকে একের পর এক নতুন এলাকা দখল করতে হত তাদের খরচ বহনের জন্য। কারণ সেনাবাহিনীর আকার বড় হচ্ছিল দিন দিন তখন তাই খরচ ও বাড়ছিল।
ইতিহাসের প্রতিটি পর্বেই দেখা গেছে লোভ করলে পতন আসে। গোর্খালীদের ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়েছে। এত বড় সেনাবাহিনীর খরচ বহনের জন্য তারা ইংরেজদের তত্ত্বাবধায়নে থাকা এলাকা দখল করতে শুরু করে। ব্রিটিশরা যদিও যুদ্ধ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তাদের তত্ত্বাবধায়নে থাকা এলাকার আক্রমণ করায় তাদের আর কিছু করার ছিলনা। তারাও সংঘাতে জড়িয়ে পরে। প্রাথমিকভাবে যুদ্ধে ইংরেজরা সুবিধা করতে পারছিল না। যুদ্ধে সফল হতে না পারায় ব্রিটিশরা তাদের ছয়জন জেনারেলের চারজনকে বরখাস্ত করে। একজন মারা যায় বাকি থাকে শুধু ডেভিড অকটারলনি।
ডেভিড অকটারলনি ছিলেন ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা শেষ বড় পদমর্যাদার সমরনেতা। অস্ত্র ও সৈন্য সংখ্যা পিছিয়ে থাকলেও গোর্খা সেনারা তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী বীরত্বের সাথে লড়াই করে যাচ্ছিল। কিন্তু শেষমেশ তারা প্রতারণা ও নিজেদের বাহিনীর ত্রুটিপূর্ণ কাঠামোর কারণে ব্রিটিশদের কাছে হেরে যায়। গোর্খালী বাহিনীতে থাকা সকলেই তাদের নিজেদের জাতের ছিল না। তাদের দখল করা অনেক এলাকা থেকেও তারা সেনাবাহিনীতে সৈন্য নিত। এই ভিন্ন এলাকার, ভিন্ন জাতের সেনারা গোর্খালি সেনানায়কদের প্রতি অনুগত ছিল না। তারা তাদের উপজাতির নেতার অনুগত ছিল। ব্রিটিশদের কাছে পৌছে যায় এই খবর। ব্রিটিশরা এর সুযোগ নিতে ভুল করে না। অনেক সেনা গোর্খালীদের পক্ষ ত্যাগ করে। ফলাফল সরূপ গোর্খাদের পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয়। এই অ্যাংলো-গোর্খা যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে গোর্খালি সেনাবাহিনীর প্রতিপত্তির ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে।
ব্রিটিশদের কাছে নেপাল একটি পশুর মত উপজাতি দ্বারা চালিত একটি দুর্গম, মশা-আক্রান্ত এবং রহস্যময় জায়গা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাদের কাছে নেপাল ছিল একদল বর্বর জাতির মানুষের আবাস। এই বর্বর দলকে নিজেদের দখলে নেওয়ার ইচ্ছাও ছিল না অধিকাংশ ব্রিটিশদের। কিন্তু তারপরও একটি কারণে নেপাল দখল করা নিয়ে আগ্রহ ছিল ব্রিটিশদের। কারণটা হলো বাণিজ্যের জন্য কাঠমান্ডু হয়ে তিব্বত পর্যন্ত পথটি ব্রিটিশদের প্রয়োজন ছিল। তাই তারা চাচ্ছিল নেপালে তাদের অনুগত কোন শাসক থাকুক। তাছাড়া কাঠমান্ডুতে ব্রিটিশদের এমন শাসকের দরকার ছিল যে, নেপালের বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। কাঠমন্ডুতে ব্রিটিশদের দুর্গ তৈরী করাতে তাদের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়। নেপালের শাসকরা ধীরে ধীরে ব্রিটিশদের অধীন চলে এসেছিল কিন্তু এটা নেপালের শাসকরা অনুভবও করতে পারেনি।
ব্রিটিশদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল গোর্খালিদের মতো শক্তিশালী কোনো সেনাবাহিনী যেন কোনো অবস্থাতেই আর নেপালে গড়ে উঠতে না পারে। তারা চাচ্ছিল নেপাল যেন কখনোই শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে। যুদ্ধের ময়দানে ব্রিটিশরা গোর্খাদের সাহসিকতাকে ভালোভাবেই দেখেছিল। তাই তারা আর গোর্খাদের তাদের বিরুদ্ধে দেখতে চায়নি বরং তারা চেয়েছিল গোর্খাদের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে। গোর্খাদের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে যুক্ত করতে তারা এক মোক্ষম চাল চেলেছিল।
১৮১৪-১৬ সালে অ্যাংলো-গোর্খা যুদ্ধের পর দুইপক্ষই শান্তি চাচ্ছিল। নতুন করে আর কোন সংঘাতের জড়াতে চাচ্ছিল না তারা। তাই ব্রিটিশ ও গোর্খারা একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের ইতি টানা। ইতিহাসে এই চুক্তি ‘’সিগুলি চুক্তি’’ নামে পরিচিত। এই চুক্তির কারণে সব থেকে বেশি লাভবান হয় ব্রিটিশরা। তারা তাদের চাওয়া পূরণ করতে পারে। প্রথম থেকেই ব্রিটিশরা নেপালে উপনিবেশ স্থাপন করতে চায়নি। তারা জানত এতে আরো জটিলতা বাড়বে তাই তারা চেয়ে ছিল শুধু মাত্র নেপালকে তাদের বশে রাখতে। এই চুক্তির মাধ্যমে তারা তা পেরেছিল। আর যুদ্ধের ময়দানে গোর্খাদের বীরত্ব ইংরেজদের হিংসার কারণ ছিল। গোর্খা সৈন্যদের উপর তাদের আলাদা লোভ ছিল। তারা চাইতো গোর্খারা তাদের বাহিনীতে থাকুক। এই চুক্তির মাধ্যমে তাদের ইচ্ছা পূরণ হয়। সিগুলি চুক্তির মাধ্যমে তারা গোর্খাদের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে যুক্ত করা সহ আরো অনেক সুবিধা হাসিল করে নেয়।
এই চুক্তির আরেকটি দিক ছিল ব্রিটিশরা নেপালের সম্পদের উপর অধিকার পেয়ে যায়। দুদিকেই লাভ হয় ব্রিটিশদের একদিকে তারা নেপালের সম্পদের অধিকার পায় অন্যদিকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া আর্মিতে গোর্খাদেরও যুক্ত করতে পারে। ফলে উপনিবেশ স্থাপনের ঝামেলা ছাড়াই আপোষে তারা সবধরণের সুবিধা গ্রহণ করতে শুরু করে। পুরো নেপাল ভোগের এর থেকে বড় সুযোগ আর হয় না। এটা ছিল ব্রিটিশদের দূরদর্শী চাল। এই চুক্তি নেপালের শাসকদের দুর্বলতা আর ব্রিটিশদের সফলতার ফল। নেপালি শাসকরা ব্যক্তিস্বার্থের কারণে জাতির স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছিল। নেপালকে উপনিবেশে পরিণত করলে তা কমনওয়েলথের সদস্য হয়ে যেত আর তখন গোর্খা সেনাদের ব্রিটিশ সেনাদের সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে হতো। যেটা ব্রিটিশরা চাচ্ছিল না। বিনা মূল্যে যেখানে পেয়ে যাচ্ছে সেই সুযোগ কি আর ছাড়ে! মূলত এই কারণেই ব্রিটিশরা নেপালকে কখনো উপনিবেশে পরিণত করেনি।
গোর্খারা আজও কাজ করে যাচ্ছে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। দুইশ বছর ধরে গোর্খা আর ব্রিটিশদের সেনাবাহিনীতে এক পথে কাজ করাটা অবাক করা। শুধু ব্রিটিশ সেনাবাহিনীই নয় ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও আছে গোর্খা সেনা নিয়ে গঠিত ছয়টি রেজিমেন্ট। ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের আগে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া আর্মিতে দশটি গোর্খা রেজিমেন্ট ছিল। দেশ ভাগের পর ছয়টি রেজিমেন্ট যুক্ত হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে। আর বাকি চারটি যুক্ত হয় ব্রিটিশ আর্মিতে। এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রায় ৩২ হাজারের মত গোর্খা সেনা রয়েছে। গোর্খারা দুটি বিশ্বযুদ্ধ ও ফকল্যান্ড যুদ্ধে অংশ নেয়ার পাশাপাশি ব্রিটিশদের হয়ে বসনিয়া, কসোভো, আফগানিস্তান, পূর্ব তিমুর ও সিয়েরা লিওনে পরিচালিত অভিযানে অংশ নিয়েছে। নেপালিরা গোর্খা সেনা হয়ে গর্ব অনুভব করে। সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গেই তারা তাদের এই ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করে।
সুত্রঃ এশিয়া টাইমস /ডেইলি বাংলাদেশ/টিআরএইচ
fb- @jshongjog / jonosongjognews@gmail.com
পাঠকের মন্তব্য