। খোজেস্তা-নূর-ই-নাহরীন।
২০০৩ এ ইংল্যান্ডে বেড়াতে গেছি, ঘটনাক্রমে মুরশেদ ভাইয়ের বাসায় নিমন্ত্রণ। ভীষণ সুন্দর বাসা পরিপাটি সিমসাম, যত্ন করে সাজানো। একটি সুসজ্জিত কামরায় দেওয়ালের এক কোনে রওশন এরশাদের ছবিতে চোখ আঁটকে গেলো। এতো রূপবতী ! বুঝতে পেরে মুরশেদ ভাই আক্ষেপের সুরে বললেন,”আমার বুবু অবিকল আমার কন্যা মুঞ্জারিনের মত দেখতে ছিলেন, অত্যাচারে অত্যাচারে জীবন শেষ।”
রওশন এরশাদের ছেলে-মেয়ে সাদ এবং জেবীন তাঁদের মামার বাসাতেই মানুষ। কাকতালীয় ভাবে জেবিনের চেহারা মায়ের সাথে ভীষণ মিল । হয়তো আদর মায়া ভালবাসার সাথে একসময় চেহারার আদলও মিশে যায়।
জেবীন ভীষণ নিরহঙ্কারী ভালো মনের একটি মেয়ে, তাঁকে দেখে বুঝার উপায় নেই তাঁর পিতা একসময়ের বাংলাদেশের দাপটশালী প্রেসিডেন্ট। মামীর সাথে অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত।
এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয়ই বলছেন পালিত কন্যা ! আরে ভাই এই শব্দটি ভুলে যান না । আমরা কজনে অন্যের বাচ্চার দায়িত্ব নিতে পারি, আদর যত্নে মানুষ করতে পারি ? কিন্তু প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও এই দুই সন্তানকে মানুষ করেছিলেন।
রওশন এরশাদকে যতবার দেখেছি মুরশেদ ভাইয়ের সেই কথাটি মনে পরেছে,”আমার বুবু —–।” বাংলাদেশের অনেক নারীর মত হা পিত্যেশ না করে তিনি প্রতিবাদ স্বরূপ নিজের সম্মান নিয়ে দূরত্ব মেইনটেইন করেছেন। বিদিশাকে বিয়ের পর একবার শুধু বলেছিলেন,”বুড়ো বয়সে আর লোক হাসায়েন না।”
আপনারা বলবেন হিলারি ক্লিনটনও তো ক্ষমতার জন্য মনিকা লিওনস্কি কেলেঙ্কারির ইম্পিচমেন্টের পরেও স্বামীর সাথে আপোষ করেছেন।আমরা সবাই তো জীবনে প্রতিনিয়ত আপোষ করেই চলি, কখনো পরিবার, সমাজ নতুবা কর্মক্ষেত্র। তবে তাঁরা করলে দোষ হবে কেন ?
২০০৮ এর শেষ দিকে বনানী সুপার মার্কেটের কর্নারের দোকানটিতে গেছি শাড়ি কিনতে । দেখি স্তূপকৃত শাড়ির সামনে মুখে লজ্জা লজ্জা হাসি টেনে এরশাদ সাহেব বসে আছেন। পছন্দ কৃত শাড়ি দেখে মনে হল তরুণীদের জন্য শাড়ি পছন্দ করছেন।
জিনাত মোশারফ, মেরী, সবিতা, বিদিশা সহ পেয়ারা ভাইয়ের রূপবতী বান্ধবীদের তো গুনে শেষ করা যাবে না। ”পেয়ারা” হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ডাক নাম। নামের কারণেই হয়তোবা প্রেমে এক প্রকারের অন্ধত্ব কাজ করতো। তাঁর জীবনটা হওয়ার কথা ছিল ব্রিটেনের রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের মত বর্ণিল, কেবলই প্রেমিক পুরুষ অথচ ছিলেন সেনা শাসক। ৯৩ বছরে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নাকি ক্ষমতা নয় কেবলই প্রেম খুঁজতেন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রতিটি সফল মানুষের জীবনে কোন না কোন একটি ট্র্যাজিক ঘটনা থাকে, বেদনা থাকে, ভীষণ শূন্যতা আর অপ্রাপ্তি থাকে। হোসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবনের ট্র্যাজেডি হচ্ছে তিনি যাকেই যখন বিশ্বাস করেছেন অর্থ কিংবা প্রেমের ক্ষেত্রে সেই নাকি তাঁর সাথে বেইমানী করেছে।
তাঁর মৃত্যুর পরে স্পেশাল চাইল্ড বা বিশেষ ভাবে সক্ষম পুত্র এরিক এরশাদকে নিয়ে প্রাক্তন স্ত্রী বিদিশাকে ঘিরে অর্থ সঙ্ক্রান্ত যে ধরণের গুঞ্জন বাতাসে ভাসছে তাও অনিভিপ্রেত।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা আজীবন লড়াকু প্রচণ্ড ধৈর্যশীলা এই নারীর জন্য কেবলই দোয়া।
জীবনে তিনি প্রেসিডেন্টের স্ত্রী, সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী হওয়া সত্ত্বেও প্রচণ্ড শূন্যতা ছিল। ছোট বেলায় বিটিভি খুললেই দামী জামদানী শাড়ি পরিহিত এই নারীর পথশিশুদের নিয়ে কর্মকাণ্ড প্রশংসিত হয়েছিল ।
প্রতিটি মানুষের জন্য মৃত্যু অবধারিত। পরিপূর্ণ বয়সে মৃত্যু স্বাভাবিক একটি বিষয়। একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই, বরং সম্ভব হলে সারা জীবনের অর্জনগুলোকে, বর্ণাঢ্য সময়গুলোকে মনে করে মৃত্যুর সময়টাকেও পারলে উপভোগ করাটা অধিকতর শ্রেয়।
মানুষের জীবনের চরম সীমাবদ্ধতা হচ্ছে সময়ে নির্ধারিত জীবনকাল। যত ধনী কিংবা ক্ষমতাবানই হোন না কেন রুর বাস্তবতা হচ্ছে ৮০/৯০ বছর বয়সে ডাইয়াপার পরে শরীরের বর্জ্যে লেটপেট হয়ে অচেতন বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রার্থনা ঠিক এমনটাই তো হওয়া উচিত। কিছু কিছু বেঁচে থাকা মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্কর । এমন বেঁচে থাকা শত্রুর জন্যও কাম্য নয়।
আমরা মানুষের জীবনের জৌলুস দেখি, ক্ষমতা কিংবা আধিপত্য দেখি, বিত্ত-বৈভব দেখি কিন্তু পেছনের অন্তহীন কান্না, কষ্টকর সমঝোতা আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। দেশের একজন বয়োজ্যৈষ্ঠ নারী, আমাদের বৃহত্তর ময়মেনসিংহের সুযোগ্য কন্যা জীবনের বাকি সময়টুকু আল্লাহ্ আপনার জন্য সহজ করে দিন, আপনার কষ্ট কমিয়ে দিন।
লেখিকা- সম্পাদক, পূর্ব পশ্চিম বিডি
(লেখিকার এফবি টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত) প্রকাশ - ৫ নভেম্বর ২০২১।
স্মৃ:স:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য