। আশেক ওসমানী।
আমার ছেলে তারিফ ওসমানীর বয়স তখন মাত্র চার দিন। হাসপাতালের ডিউটিরত মেডিকেল অফিসার এসে রিপোর্ট দেখিয়ে জানালেন, আপনার স্ত্রী সুস্থ আছেন, তবে আপনার ছেলের জন্ডিসের রিপোর্ট ১৮.৬ যা খুবই উদ্বেগজনক, যে কোন সময় খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।
আমরা আপনার ছেলেকে ভর্তি রাখতে পারবনা, আমাদের ফটোথেরাপী মেশিন নষ্ট, তাই অন্যকোন হাসপাতালে নিয়ে যান। আমি তখন আমার সন্তানকে নিয়ে অন্য একটা হাসপাতালে ভর্তি করালাম। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন, আপনার বাচ্চার যে কোন সময় যে কোন কিছু হয়ে যেতে পারে।
আমি ডাক্তার স্যারকে বললাম যে কোন খারাপ পরিস্থিতি মেনে নিতে আমি রাজি আছি, আপনি আমার সন্তানের চিকিৎসা শুরু করুন। তার পর ডাক্তার নার্সকে ডেকে বাচ্চাকে ফটোথেরাপী বক্সে দিতে বললেন, সাথে এটাও বলে দিলেন; বাচ্চার চোখে যেনো ফটোথেরাপীর লাইটের আলো না পড়ে।
চিকিৎসা চলছে, এর মাঝে বর্তমানে বাচ্চার কি অবস্থা তা দেখার জন্য ব্লাড নিতে আসলো নার্স। জন্ডিসের কারনে বাচ্চার শরীর এমনিতেই হলুদ, অনেক চেষ্টা করেও ব্লাড নিতে পারলোনা নার্স। একটু পরেই নার্স আবার এসে বললো, আপনার বাচ্চাকে আপারেশন থিয়েটারে নিয়ে লাইটের আলোয় চেষ্টা করে ব্লাড নিতে হবে বলে বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে গেল।
কিছু সময় পরে নার্স এসে বাচ্চাকে আবার ফটোথেরাপী বক্সে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল, বললো বিকাল ৬:oo টায় রিপোর্ট পাবেন। অপেক্ষায় আছি কখন রিপোর্ট আসবে! ঘড়ির কাটায় ঠিক ৫:oo টায় ওই নার্স আবার এলো।
আমার সাথে একটু কথা আছে বলে রুমের বাইরে ডেকে নিলো আর বললো- ভাইয়া আমি একটা ভুল করে ফেলেছি, আপনার সন্তানের কাছ থেকে ব্লাড কালেকশন করেছিলাম ঠিকই কিন্তু আরেকটা জরুরী প্যাশেন্ট দেখতে গিয়ে স্যাম্পলটা ল্যাবে পাঠাতে ভুলে গিয়েছিলাম, এখন আপনার ছেলের ব্লাড স্যাম্পলটা খুঁজে পাচ্ছিনা।
কথাগুলো বলার সময় আমার চোখের পানির সাথে সাথে নার্সেরও চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছিল আর বলছিল আমার স্যার জানলে আমার চাকরিটা চলে যাবে আর আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে, দোষটা সম্পূর্ণ আমার।
আমি এখন কি করবো ভাই? আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে একটা সুযোগ দিবেন আপনি? আমি আবার আপনার ছেলের কাছ থেকে ব্লাড নিয়ে, ল্যাবে পাঠাই? তার সেই বিনয়ী অনুরোধে কষ্টে বুক ফেটে কান্না আসছিল আমার, প্রচন্ড রাগও হচ্ছিলো।
হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়লো, বাবা আমাদের সবাইকে বলতেন কোন অপরাধীর অপরাধ স্বীকার করার সময় যদি চোখে পানি দেখো, তবে তাকে ক্ষমা করে দিয়ো। এ ক্ষমার বিনিময়ে আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন এবং তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।
এক বুক কষ্ট নিয়ে নার্সকে বললাম ঠিক আছে করুন, আমি ধর্য্য ধরলাম, নিশ্চিন্তে থাকেন আমি কাউকে কিছু বলবোনা। তারপর আবার আমার ছেলেকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে ব্লাড নিলো, ল্যাবে পাঠিয়ে দিলো, আর আমি কাঁদছি।
আর আল্লাহর কাছে দু-হাত তুলে বললাম- আল্লাহ কারো বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ নেই, তবে তোমার উপর আমার ভরসা আছে, তুমি আমার এ ধৈর্য্য ধরার উসিলায় হলেও আমার ছেলেটাকে ভাল করে দাও।
আলহামদুলিল্লাহ দুই দিন চিকিৎসা নিয়ে আমার বাচ্চাটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো। হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার সময় আমি ওই নার্সকে ডেকে ধন্যবাদ দিলাম, সাথে সাথে নার্স আবার কেঁদে দিল; আর বললো- আল্লাহ আপনার ছেলেকে সুস্থ রাখুক। আলহামদুলিল্লাহ সেইথেকে আমার ছেলে ভালো আছে এখনও।
পরামর্শ : কঠিন মূহুর্তেও রেগে গিয়ে প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহর কাছে সাহায্য চান। আল্লাহ হয়তো কোন না কোন উসিলায় আপনাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন ইনশাআল্লাহ।
মন্তব্যঃ আমার সন্তানের বাস্তব এ ঘটনা লিখতে গিয়ে বার বার আমার চোখের পানিতে কী-বোর্ড ভিজে যাচ্ছিলো, তাই লেখনীতে ভাষাগত কোন ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই। ধন্যবাদ।
—————–
লেখক-
হেড অব প্ল্যানিং (ফরাজী গ্রুপ)
কারাতে প্রশিক্ষক (ওসমানী কারাতে ক্লাব)
(২৬ডিসেম্বর,২০২১ তারিখে প্রকাশিত লেখকের টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত)
মা:স:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য