। আনিসুল হক।
টিসিবির ট্রাকের সামনে লাইন দেখি। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে খামারবাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিমে গোলচক্করের পুব পাশে একটা ট্রাক দাঁড়ায়। ওইখানে ট্রাকের পাশে লোকজনকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। কখনোবা ট্রাক আসেনি, কিন্তু ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলারা অপেক্ষা করছেন; তাঁদের পরনে রঙিন পোশাক, লক্ষ করি। একদিন, দুই তরুণী, রিকশায়, রোদের মধ্যে ডাকটিকিটের মতো তাঁদের উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল, ওই ট্রাকের সামনের ভিড়ে গিয়ে মিশে গেলেন।
আমার শৈশবের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। ছেলেবেলায় আমাদের একটা নিয়মিত ডিউটি ছিল রেশনের দোকানে যাওয়া। আমরা যেতাম সরকারি কর্মচারীদের রেশনের দোকানে। একটা হলুদ কি গোলাপি রঙের রেশনের কার্ড ছিল আমাদের। সেটা নিয়ে যেতে হতো রেশনের দোকানে। সাইকেলে চড়ে যেতাম। ফেরার সময় মাইলখানেক পথ সাইকেলটার হ্যান্ডেল ধরে হেঁটে ফিরতে হতো। কারণ, একটা গমের বস্তা, তাতে আধা মণের মতো গম, সাইকেলের তিনকোনা পাইপ দুটোর মাঝখানে চেইনের গোল চক্রটার ওপরে ব্যালান্স করে রেখে দিতাম। অনেকটা গাধার পিঠে যেভাবে বোঝা রাখতে হয় ব্যালান্স করে, সেই রকমভাবে। সাইকেলের দুই হাতলে ঝুলত দুটো ব্যাগ। তার একটাতে চিনি, আরেকটাতে সয়াবিনের একটা বোতল। সেই সাইকেল ধরে ঠেলতে ঠেলতে বাসায় ফিরতাম। ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ কেন হাঁটিয়া চলিয়াছিলেন, তখন বুঝতে পারতাম। সাইকেল নিয়েও হেঁটে বাড়ি ফেরা যায়!
শুধু রেশন আনলেও চলত না, এরপরের কাজ ছিল গম ভাঙিয়ে আটা বানানোর জন্য রাইস মিলে যাওয়া। পদ্ধতি একই রকম। সাইকেলের দুই রডের মধ্যে বস্তাটা ফেলে সাইকেল ঠেলে চললাম ধাপের মোড়ে। সেইখানে মিল চলছে সশব্দে। বাতাসে উড়ছে আটা কিংবা ধানের খোসার কণা। পুরোটা মেঝেতে আটা বা তুষের গুঁড়ার আস্তর পড়ে আছে। আঙুল দিয়ে তাতে ছবি আঁকা চলে। মিলের যিনি শ্রমিক, তাঁর মাথায় গামছা বাঁধা। তঁার সমস্ত শরীর ধূসরিত। আমার গমের বস্তাটাকে লাইনে রাখলাম। সামনে আরেও তিন-চারটা বস্তা আছে। সেসব ভাঙানো হলে পরে আমারটা মেশিনে ঢালা হবে। ঢালার জন্য একটা চারকোনা চোঙাকার মুখ আছে। চাকা ঘুরছে। চাকার সঙ্গে ঘুরছে একটা বেল্ট। সেই বেল্টে যদি তোমার গা লেগেছে তো সর্বনাশ। আর মেশিনের মধ্যে হাত ঢুকে গেলে তো হাত কাটা যাবে। গম পিষে মেশিন আটা বের করছে আরেক পাশ দিয়ে। তার মুখে একটা কাপড়ের থলে। সেটা দিয়ে আটা পড়ছে। নিজের বস্তায় আটা ভরে আবার তোলো সাইকেলে। ফিরে এসো বাসায়।
আম্মাদের কাজ এবার হবে আটা চালা। একটা চালুনি আছে। সেটার আকার একটা থালার সমান। চারদিকে একটা টিনের ঘের। মধ্যখানে মিহি জাল। সেটাতে আটা রেখে চালতে থাকলে নিচে আটা পড়ল, ওপরে জমে রইল গমের খোসার গুঁড়া। সেই গুঁড়া কি হাঁস–মুরগিকে খেতে দেওয়া হতো, নাকি তা দিয়ে সুজি বানানো হতো আজ আর মনে নেই। সে একটা সময় ছিল, যখন কোনো কিছুই ফেলা হতো না। লাউয়ের আগা, ডগা খাওয়া তো হতোই, ছালও খাওয়া হতো ভাজি করে। কুমড়ার বিচি ভাজা ছিল বিশেষ রকমের আনন্দভোজ। সে এক সময় ছিল, যখন আমরা কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতাম, সাবান দিয়ে চুল ধুতাম; টিউবওয়েলের নিচে বসে গোসল সারতাম; স্পঞ্জের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেলে ল্যাম্পোর আগুনে ফিতা গলিয়ে লাগিয়ে নিতাম; ফুটবলের ব্লাডার ফুটো হলে সাইকেল মেকানিকের কাছে গিয়ে পট্টি লাগিয়ে নিয়ে জুতার মুচিকে দিয়ে সেলাই করিয়ে নিতাম। পাড়ার জঙ্গলের আতাগাছে ফুল ফুটলে সবরি কলার সুগন্ধ ছুটত, সেই আতা পেড়ে এনে চালের বস্তায় রেখে দিলে কয়েক দিন পরে পেকে পরম সুস্বাদে আমাদের মুখ ভরিয়ে দিত।
শীতের সকালে নারকেল তেল জমে থাকত, উঠোনে রোদে রাখতাম গলানোর জন্য, গলার আগেই স্কুল যেতে হবে, কাজেই পাটখড়ি ঢুকিয়ে জমাট বাঁধা তেল বের করে নিয়ে মাথায় মেখে দল বেঁধে হেঁটে হেঁটে বইখাতা হাতে স্কুলে যেতাম।
সেই সব দিন তো চলে গেছে। কিন্তু আজ যখন দেখি, টিসিবির ট্রাকের সামনে ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদের লাইন, তখন সেই সব দিন যেন ফিরে আসতে চায়।
টিসিবির একটি সূত্র থেকে জানতে পারছি, ট্রাক থেকে একজন ক্রেতা এখন এক কেজি করে চিনি ও মসুর ডাল, দুই লিটার পর্যন্ত সয়াবিন তেল কিনতে পারবেন। এ ছাড়া পেঁয়াজ কিনতে পারবেন তিন থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত। টিসিবির ট্রাকে প্রতি কেজি চিনি ৫০ টাকা, মসুর ডাল ৫৫ টাকা ও পেঁয়াজ ৩০ টাকায় পাওয়া যাবে। তবে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনতে ক্রেতার খরচ পড়বে ১১০ টাকা। এখন বাজারে সয়াবিনের দাম কমবেশি ১৬০ টাকা লিটার। চিনি বাজারে ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা। তার মানে কেউ যদি ২ কেজি চিনি ট্রাক থেকে কেনেন, বাঁচবে কম করেও ৪০ টাকা। হয়তো ট্রাক থেকে ৬০০ টাকার পণ্য কিনলে ১৫০-২০০ টাকা কমে পাওয়া যাবে। কম নয়! মধ্যবিত্ত তাই লাইনে দাঁড়ান। সব সময় ট্রাক আসে না। তাঁরা দাঁড়িয়েই থাকেন। দুই ঘণ্টা রোদ্দুরে, কুয়াশায়, বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকলে যদি ২০০ টাকা বাঁচে, কম কী! মানুষ আসলে কষ্টে আছে!
লেখক - কবি, কলামিষ্ট, সাংবাদিক
(লেখকের টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত)
সূত্র- prothomalo.com
প্রকাশ- ২১ জানুয়ারি,২০২২
স্মৃ:স:/জ:নি:
পাঠকের মন্তব্য